ক্যাম্পাস

জবি ছাত্রদের স্বপ্ন এখন বাস্তব, যা আছে নতুন হলে

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্রদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তব করেছে বেসরকারি সেবামূলক সংস্থা আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় ৮৮৮ জন শিক্ষার্থীর জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করেছে তারা। আবাসনের পাশাপাশি ছাত্রদের জন্য তিনবেলা খাবার, চারটি কম্পিউটার ল্যাব, ভাষা প্রশিক্ষণ (ইংরেজি, বাংলা ও আরবি), নৈতিক শিক্ষা এবং ক্যারিয়ার উন্নয়ন সেমিনারের সুবিধা রাখা হয়েছে। ছাত্রদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় ও ফজরের পর পবিত্র কোরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে খুশি ধার্মিক শিক্ষার্থীরা।

হলে থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রিফাত হোসেন বলেন, ‘আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের হলে উঠে আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো লাগছে। সময়মতো নামাজ, কোরআন শিক্ষা, পড়াশোনা ও আইইএলটিএস কোর্স সব মিলিয়ে এটি একটি সুশৃঙ্খল ও নৈতিকভাবে গড়ে ওঠার পরিবেশ, যা একজন শিক্ষার্থীকে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক।’ ২০০৫ সালে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলেও এতদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো আবাসিক হল ছিল না। কলেজ আমলের ১১টি আবাসিক হল বেদখলে থাকায় জবি দেশের অন্যতম অনাবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত ছিল। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। আবাসিক সংকট কিছুটা নিরসনে ২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে তারা।

আরও পড়ুন পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশে ভালো মেসও জোটে না জবি শিক্ষার্থীদের পুরান ঢাকায়ই হবে জবির দুই হল, কেরানীগঞ্জে অস্থায়ী আবাসন আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের ঘর পেলো ১৬০ পরিবার আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনে সুযোগ পাচ্ছেন জবির নবীন শিক্ষার্থীরা

আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের ‘মেধাবী’ প্রকল্পের আওতায় এই হলের কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ (১৯ ব্যাচ) ও ২০২৪-২৫ (২০ ব্যাচ) শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা হয়েছে। এজন্য দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় পোর্ট কনটেইনার রোডের একটি নতুন ১০ তলা ভবন ভাড়া নেওয়া হয়েছে।

আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় নতুন হলে পড়াশোনা করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ছবি: জাগো নিউজ

প্রাথমিকভাবে হলে থাকার জন্য শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। তবে শিক্ষার্থীদের পারিবারিক আয় ও মেধার ভিত্তিতে ১০০, ৭৫, ৫০ ও ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃত্তি দিয়েছে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ৭০০ জন শিক্ষার্থীর আবাসনের পরিকল্পনা ছিল; পরে তা বাড়িয়ে ৮৮৮ জন শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

গত ১৬ জুলাই শিক্ষার্থীরা আনুষ্ঠানিকভাবে হলে উঠতে শুরু করেন। প্রথম দিনেই ৩০৪ জন শিক্ষার্থী হলে ওঠেন, সবাই ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী। এ ব্যাচ থেকে ৫৪০ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেন। এর মধ্যে ৩৭৭ জন শিক্ষার্থীকে চূড়ান্ত করা হয়। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর ৪৫ জন শিক্ষার্থী সিট বাতিল করেন। ফলে বর্তমানে ৩৩২ জনের জন্য আসন বরাদ্দ নিশ্চিত করা হয়েছে।

হল সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আগামী ১ আগস্ট থেকে নতুন করে আরও ২৭৩ জন শিক্ষার্থী হলে উঠবেন, যাদের মধ্যে ২৮ জন ১৯ ব্যাচের এবং ২৪৫ জন ২০ ব্যাচের শিক্ষার্থী। ২০ ব্যাচ থেকে আবেদন জমা পড়েছিল ৩৮০ জনের, যাদের মধ্যে ২৪৫ জনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে।

আস-সুন্নাহর ছাত্র হল ক্যাম্পাস থেকে দূরে হওয়ায় যাতায়াতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিদিন দুটি বাস বরাদ্দ রয়েছে। বাস দুটি যথাক্রমে সকাল সাড়ে ৭টায় ও সকাল ৯টায় শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেয়।

আরও পড়ুন বালু ভরাট-লেক-পুকুর খননে ৯ বছর পার, অবকাঠামো কবে? জবির জন্ম থেকেই তীব্র আবাসন সংকট, অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৪০ জন পেলেন আস সুন্নাহর অটোরিকশা

হল কর্তৃপক্ষ জানায়, হলটিতে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসনের পাশাপাশি তিনবেলা স্বাস্থ্যকর খাবার, আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব, ক্যামব্রিজভিত্তিক ইংরেজি কোর্স, আইটি ও এআই প্রশিক্ষণ, নৈতিক শিক্ষা এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য মাইন্ড ট্রেনিং সেশনসহ নানান সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।

বর্তমানে হলে থাকা সব শিক্ষার্থী মুসলিম। আবাসনের পাশাপাশি তাদের জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কিছু নিয়ম মানা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। হল ভবনের তৃতীয় তলায় নামাজের জন্য মসজিদ রয়েছে। সেখানে নিয়মিত নামাজ আদায় করতে হবে এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফজর ও মাগরিব নামাজের পর শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি চেক করা হয়। ফজরের নামাজের পর থাকতে হয় কোরআন শিক্ষার ক্লাসে। সময়মতো ঘুমানোর জন্য রাত ১১টায় বাতি বন্ধ করা হয়। আবার ভোরে ফ্যান বন্ধ করে বাতি জ্বালিয়ে ঘুম ভাঙানো হয়। আসর থেকে মাগরিবের সময়টুকু শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো সময় কাটান। অন্য সময়ে বের হতে চাইলে এন্ট্রি খাতায় কারণ লিখতে হয়। ছুটির জন্য নির্ধারিত ফরমে কো-অর্ডিনেটর বা ইনচার্জের অনুমতি প্রয়োজন। হলের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রতি ফ্লোরে সাত সদস্যের কমিটি রয়েছে।

প্রতিবেলায় শিক্ষার্থীদের খাবারে থাকছে দু-তিনটি পদ। এর মধ্যে রয়েছে ভাত, মাছ, ডিম, গরুর মাংস, মুরগির মাংস, সবজি, লাউ চিংড়ি, আলু ভর্তা, আলুর ঘাঁটি, ডাল, মুড়িঘণ্ট, বেগুন, মুরগি খিচুড়ি, সবজি খিচুড়ি ও চাইনিজ সবজি।

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থী মোহন খন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘদিনের আবাসন সংকটের অবসান ঘটিয়ে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা আমাদের স্বপ্ন পূরণের মতো। শুধু থাকার সুযোগ নয় বরং মূল্যবোধ, আইটি, ভাষা ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালিয়ে এটি এক অনন্য মডেলে পরিণত হয়েছে।’

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থী রহমতুল্লাহ মাক্কি বলেন, ‘আমি আশা করেছিলাম তার চেয়ে বেশি কিছু পেয়েছি। এখানে নিরাপদ আবাসন, খাওয়ার ব্যবস্থা, পড়াশোনার পরিবেশ এবং কম খরচ তো আছেই, পাশাপাশি বিভিন্ন স্কিল শেখার সুযোগ রয়েছে। নিয়মমাফিক জীবনযাপন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বাধ্যতামূলক হওয়াটাও আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করছে।’

তবে হলে সিট পেয়েও তা বাতিল করা ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রাকিবুল হোসেন বলেন, ‘হাসপাতালের মতো বেডে একটি ফ্লোরে ৯৬ জন করে থাকছে। ক্যাম্পাস থেকে অনেক দূরে আর কঠোর নিয়মকানুন। সব মিলিয়ে হলে থাকাটা আমার কাছে একঘেয়ে ও সীমাবদ্ধ মনে হয়েছে। ক্লাবের কাজেও অংশ নিতে বাধা। তাই সিলেকটেড হলেও আমি হলে উঠিনি।’

হলে আগামী ১ আগস্ট থেকে ইংরেজি, আইটি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের জেনারেল সেক্রেটারি মো. সাব্বির আহম্মদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্যামব্রিজের কারিকুলাম অনুযায়ী ইংরেজি কোর্স পরিচালিত হবে, যার লক্ষ্য এক বছরের মধ্যে আইএলটিএসে শিক্ষার্থীদের ৭ স্কোর অর্জন নিশ্চিত করা। বেসিক আইটি কোর্সের পর থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রশিক্ষণ। শিক্ষার্থীদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বট তৈরির সক্ষমতা গড়ে তোলাই লক্ষ্য। এসব প্রশিক্ষণ পরিচালনায় দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সাপোর্ট, পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার নিশ্চিত করতে থাকবেন একজন নিউট্রিশনিস্ট। পুরো পরিবেশ থাকবে সহানুভূতিশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ। পাঁচ বছর পর শিক্ষার্থীরা যা হতে চান, তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেওয়া হবে।’

আরও পড়ুন জবি শিক্ষার্থীদের ‘আবাসন বৃত্তি’ কতটা যৌক্তিক, আদৌ কি মিলবে? ‘মেধাবী’ প্রকল্পে ৫৪০ জবি শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার শুরু ১৪ জুন জবির ৭০০ শিক্ষার্থীর আবাসনের দায়িত্ব নিলো আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন

সার্বিক বিষয়ে জবি ছাত্র হল-১ এর প্রভোস্ট সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান সাদী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সবাই অনেক খুশি। তবে কিছু শিক্ষার্থী চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েও হলে ওঠেনি। কারও টিউশনি করে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়, কেউ ব্যক্তিগত কারণে সিট বাতিল করেছে। আগামী সপ্তাহে পর্ষদের মিটিংয়ে ঠিক করা হবে এ বাড়তি সিটগুলো কীভাবে পরিচালনা ও পূরণ করা হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. তাজাম্মুল হক বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি। এটা একাডেমিক ও নৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘আবাসন সংকট ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের এ উদ্যোগ আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি স্বপ্ন বাস্তবের পথে নিয়ে যাচ্ছে।’

টিএইচকিউ/এমআরএম/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম