অর্থনীতি

চব্বিশের অস্থিতিশীলতায় ‘তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় বাংলাদেশ’

বিশ্বের তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকা শীর্ষ পাঁচ দেশের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। গত সপ্তাহে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন গত বছরের (২০২৪) খাদ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থার (এফএও, ইফাদ, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফ) যৌথভাবে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’ এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পৃথক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এতে বলা হয়, তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের খাদ্য সংকটের কারণ হিসেবে ২০২৪ সালের দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অসুবিধার সম্মিলিত প্রভাবকে দায়ী করা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু খাদ্যনিরাপত্তার সংকটেই নয়, স্বাস্থ্যকর বা সুষম খাদ্য গ্রহণের দিক থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে। এ বিষয়ে গত সাত বছরে অনেকটা উন্নতি হলেও এখনো দেশের ৭ কোটি ৭১ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পায় না। দেশের ১০ শতাংশের বেশি মানুষ অপুষ্টির শিকার।

এর মধ্যে তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তার শিকার মানুষের সংখ্যা অনুযায়ী শীর্ষ দেশগুলো হচ্ছে— নাইজেরিয়া, সুদান, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, বাংলাদেশ ও ইথিওপিয়া। তবে জনসংখ্যার অনুপাতে খাদ্যসংকটে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা, দক্ষিণ সুদান, সুদান, ইয়েমেন ও হাইতি।

আরও পড়ুন

গুদামে রেকর্ড মজুত, বোরোতে সর্বোচ্চ ধান-চাল সংগ্রহের পথে সরকার সেন্টমার্টিনে নৌযান চলাচল বন্ধ, দ্বীপে খাবার সংকট ৪ লাখ টন চাল কিনবে সরকার, বেসরকারিভাবে ৫ লাখ টন আনার অনুমতি

তবে এখন বাংলাদেশে যথেষ্ট খাদ্য মজুত আছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সরকার বলছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন।

কারণ বর্তমানে সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুত এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাড়ে ২০ লাখ টনের বেশি ধান-চাল ও গমের মজুতকে রেকর্ড বলছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে চলতি বোরো মৌসুমে ধান ও চালের সর্বোচ্চ সংগ্রহের পথে সরকার।

এবার বোরোতে ধান-চালের সংগ্রহ ১৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ ফসলে এর আগে এত পরিমাণ সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি গুদামে মোট খাদ্যশস্যের মজুত এখন ২০ লাখ ৫৪ হাজার টন। এর আগে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সরকারি সর্বোচ্চ খাদ্যশস্যের মজুত ১৯ লাখ ৮৫ হাজার টন হয়েছিল।

এমন পরিস্থিতিতে ওই দুই প্রতিবেদন প্রসঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) মহাপরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, দেশে খাদ্যের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত আছে।

তিনি বলেন, তবে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা ও ভৌগোলিক খাদ্য উৎপাদনের কিছু ঝুঁকি রয়েছে। যেমন নিরাপদ খাদ্য কিছুটা চ্যালেঞ্জ, আবার এমন সময় ওই প্রতিবেদনের তথ্য নেওয়া হয়েছে যখন দেশে দুর্যোগসহ নানা অস্থিরতা ছিল। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি আমরা খুব ভালোভাবে মোকাবিলা করেছি। খাদ্য উৎপাদন ও প্রাপ্তি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।

আরও পড়ুন

নিরাপদ খাদ্যের অভাবে রপ্তানির সুযোগ কাজে লাগছে না: খাদ্য উপদেষ্টা অর্থবছর শেষে চালের মজুত বেড়েছে

এ ধরনের প্রতিবেদনগুলো চারটি সূচক বিবেচনা করা হয়। খাদ্যের পর্যাপ্ততা, প্রাপ্যতা, ক্রয়ক্ষমতা এবং টেকসইতা। আমাদের প্রথম দুই সূচকে কোনো সমস্যা নেই। যে কারণে পিছিয়ে গেছি বলে মনে হয়, গত বছর বিভিন্ন সময় মুদ্রাস্ফীতি হয়েছিল, অনেকে চাকরি হারিয়েছে, যাতে ক্রয়ক্ষমতা এবং বন্যা ও দুর্যোগের কারণে টেকসইতা কমেছে।

গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ একটি গুরুতর খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। যেখানে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ২ দশমিক ৩৬ কোটি মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল, যার মধ্যে কয়েক জেলায় ব্যাপক বন্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের বিধ্বংসী প্রভাব।

এ খাদ্য সংকট আরও তীব্র হয় ২০২৪ সালের মে মাসে। যখন ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাত এবং পরবর্তী আকস্মিক বন্যায় কৃষি, পশুপালন এবং মৎস্য খাতে আনুমানিক ৫৯৬ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়, যা এক দশমিক ৭ মিলিয়ন কৃষক পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

ওই সময় জলোচ্ছ্বাসের কারণে লবণাক্ত পানি কৃষিজমিতে ঢুকে পড়ে, যা মাটিকে চাষের অনুপযোগী করে তোলে। এর ফলে দেশের প্রধান ফসল ধানের উৎপাদনসহ শস্য উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়েছে। বাড়িঘর, অবকাঠামো এবং জীবিকার ব্যাপক ধ্বংসের কারণে অনেক সম্প্রদায়, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ, ঘুরে দাঁড়াতে হিমশত্রু হয়েছে।

এ চ্যালেঞ্জগুলোর পাশাপাশি ছিল সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। গত বছর ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বাড়ায় দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিক্ষোভসহ রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিস্থিতি বিষয়টি আরও জটিল করে তোলে, যা দৈনন্দিন জীবন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত করে।

এনএইচ/এমএএইচ/এমএস