একুশে বইমেলা

বিভূতিভূষণের ‘পুঁইমাচা’: জীবনের চূড়ান্ত সীমারেখা

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পুঁইমাচা’ গল্পে যে সমাজের কথা বলেছেন; সে সমাজে বিষফোঁড়ার মতো স্থান করে নিয়েছে বাল্যবিবাহ আর যৌতুক প্রথা। গল্পে তিনি জীবনের জটিল মনস্তত্বের কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাননি বরং দীনহীন একটি পরিবারের স্বাভাবিক করুণ কাহিনি সহজ-সরল ভাষায় বর্ণনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজের একটি চিত্র এঁকেছেন।

গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ক্ষেন্তি। ক্ষেন্তির মৃত্যুর কারণ বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লালিত পণপ্রথা। গল্পটি বুর্জোয়াতন্ত্র এবং সামন্ততন্ত্রের নোম্যানসল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষয়িষ্ণু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিষবৃক্ষটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ক্ষেন্তি মারা যাওয়ার পর আরও দীর্ঘ আট মাসের বর্ণনা গল্পে আছে। অর্থাৎ ট্র্যাজেডিই জীবনের চূড়ান্ত সীমারেখা। এটি বিভূতিভূষণের সাহিত্য দর্শনের ক্ষেত্র নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘বেদনানুভূতি আসলে আত্মানুভূতি ছাড়া আর কিছু নয়। দুঃখের সংবেদন আত্মবেদনকেই গভীর করে তোলে। আর আত্মসংবেদন যত গভীর হয়; ততটা নিজের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা জীবনের স্বর্গীয় গতি।’ ‘পুঁইমাচা’ জীবনের সেই আত্মজীবনকে চিনিয়ে দেয়।

সংসার, যাপিতজীবন, সমাজের রীতিনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন সহায়হরির সাথে বাস্তববাদী, নীতি-নৈতিকতায় বলিষ্ঠ, কঠোর অথচ মমতাময়ী একজন নারীর চরিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পুঁইমাচা’ গল্পে একটি সমাজের কথা বলেছেন। স্ত্রী এবং চার মেয়েকে নিয়ে সহায়হরির অভাব-অনটনের সংসার। বড় মেয়ের বয়স চৌদ্দ-পনেরো। এ বয়সেও বিয়ে না হওয়ায় তার স্ত্রীর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। মেয়ের বিয়ে না হওয়ায় তাকে যে একঘরে করার কথা হচ্ছে; সেই উদ্বেগের কথা সে তার স্বামীকে জানায়। সহায়হরির সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সংসারের প্রতি তার এ উদাসীনতার রাগ গিয়ে পড়ে মেয়েদের ওপর।

এক বিকেলে বড় মেয়ে ক্ষেন্তি কিছু পুঁইশাক আর চিংড়ি মাছ চেয়ে-চিন্তে নিয়ে আসে। বড় মেয়ে ক্ষেন্তির পছন্দ কুচো চিংড়ি দিয়ে পুঁইশাক। কিন্তু মায়ের রাগের তোড়ে তা ফেলে দিয়ে আসতে হয়। পরে বাড়িতে যখন কেউ না থাকে; তখন তার মা ফেলে দেওয়া পুঁইশাক কুড়িয়ে নিয়ে এসে রাঁধে। দুপুরে খেতে বসে পুঁইশাক পাতে দেখে ক্ষেন্তির চোখ ছলছল করে ওঠে। পুঁইশাক ক্ষেন্তির এত পছন্দ যে, সে ঘরের কোণেও পুঁইশাক লাগিয়ে রাখে। মাচাভর্তি সেই পুঁইশাক লকলক করে বাড়তে থাকে।

আরও পড়ুন

জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’: অসামান্য সংযোজন জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প’: ইতিহাসের অংশ

বৈশাখ মাসের প্রথমে সহায়হরির এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের ঘটকালিতে ক্ষেন্তির বিবাহ হয়ে যায়। দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ করলেও পাত্রটির বয়স চল্লিশের খুব বেশি কোনোমতেই হবে না। দীনহীন সহায়হরি যৌতুকের টাকা ধীরে ধীরে শোধ করছিল। কিন্তু টাকা না পেয়ে ক্ষেন্তির ওপর অত্যাচার বাড়তে থাকে। এর মাঝে মেয়ের বসন্ত হলে গা থেকে সোনা-গয়না খুলে তাকে ফেলে রেখে যায় পাশেই অপরিচিত এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সে বাড়িতেই মৃত্যু হয় ক্ষেন্তির।

কিন্তু ক্ষেন্তির লাগানো সে পুঁই গাছটি মরেনি। ক্ষেন্তির সমগ্র জীবনের সাক্ষী হয়ে, তার সমস্ত সাধ আহ্লাদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে, তার না থাকার শূন্যতাকে বুকে ধারণ করে, তার শত-সহস্র স্মৃতির উৎস হয়ে মাচাভর্তি সেই পুঁইশাক লকলক করে বাড়তে থাকে। পুঁইমাচার লাবণ্যে ভরপুর কচি সবুজ ডগাগুলোর মাঝে মা এবং বোনেরা যেন ক্ষেন্তির অবয়ব খুঁজে পায়। পৌষসংক্রান্তির রাতে এর দিকে তাকিয়ে এমন ডাগর ডাগর মেয়েটির অকাল প্রয়াণের কথা স্মরণ করে মা এবং মেয়েরা নির্বাক বসে থাকে।

কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতিপ্রেমিক ও নির্জন প্রান্তবাসী। প্রকৃতির সাথে মানব মনের যে একটি অন্তর্গুঢ় সম্পর্ক আছে, বিভূতিভূষণের সব রচনায় তা বিশেষভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। ফলে তাঁর সব রচনায় প্রকৃতিপ্রেমচেতনা মুখ্য হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির মধ্যে মানুষ জীবনের সত্যবোধ খুঁজে পেয়েছে। প্রকৃতির মনোরম পরিবেশ থেকে ছিন্ন হয়ে একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের কন্যা ক্ষেন্তি কীভাবে অকাল মৃত্যুবরণ করল, তারই মর্মন্তুদ কাহিনি ‘পুঁইমাচা’ গল্পে পরিবেশিত হয়েছে।

ছোট সুখ, ছোট আশা নিয়ে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে কীভাবে অভিন্ন হয়ে প্রতীকী রূপ লাভ করে, পুঁইমাচা গল্পে তা সবিশেষ পরিলক্ষিত হয়। পুঁইমাচা লেখকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। গল্পটি গ্রামবাংলার একটি দরিদ্র পরিবারকে কেন্দ্র করে দানা বেঁধে উঠেছে।

এসইউ/এমএস