বিগত কয়েক বছর ধরেই নানা কারণে নারায়ণগঞ্জের পোশাক খাতে বেশ অস্তিরতা চলছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এটা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। ধাক্কা সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন শিল্প-কারখানার মালিকরা। এ অবস্থায় ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ২৬টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন পাঁচ হাজার ৩৪২ জন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, উৎপাদন অপ্রতুলতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ বিভিন্ন কারণে নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানাগুলোতে অস্থিরতা বেড়েছে। শ্রমিক আন্দোলনের কারণে ব্যাহত হচ্ছে কারখানার উৎপাদন। ফলে সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে কারখানাগুলো। সবমিলিয়ে চাপ সামলাতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা।
জেলা শিল্পাঞ্চল পুলিশ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বতর্মানে নারায়ণগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে এক হাজার ৮৩৪টি পোশাক কারখানা রয়েছে। বিভিন্ন কারণে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত এক বছরে ২৬টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে চাকরি হারিয়েছেন পাঁচ হাজার ৩৪২ জন। ২০২৪ সালের শুধু জুলাই মাসেই বন্ধ হয়ে গেছে ১০টি পোশাক কারখানা।
‘নারায়ণগঞ্জে যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, এসব কারখানার বেশিরভাগ শ্রমিক বেঁচে থাকার জন্য এখন অটোরিকশা চালাচ্ছেন। কিছু শ্রমিক গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। আবার কিছু সংখ্যক শ্রমিক দিনমজুরের পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।’
নারায়ণগঞ্জ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের হিসাবমতে, নারায়ণগঞ্জে নিবন্ধনকৃত পোশাক কারখানার সংখ্যা এক হাজার ১০টি। এর মধ্যে গত এক বছরে মোট ৯টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: চাঁপাইনবাবগঞ্জে তৈরি হচ্ছে ড্রাই ম্যাংগোঅর্ডার সংকটে বার্ডস কারখানা বন্ধ ঘোষণাএকসময়ের কর্মমুখর কারখানা এখন ‘ভুতুড়ে বাড়ি’রাজনীতির আগুনে কারখানা ছাই, শ্রমিক-কর্মচারীদের বোবাকান্না২২ বছর বন্ধ থাকার পর প্রাণ ফিরেছে রাজশাহী টেক্সটাইল মিলেবন্ধ হয়ে যাওয়া নীট গার্ডেন কারখানার অ্যাডমিন কামরুল হোসেন রনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কারখানাটিতে সাড়ে ৪০০ শ্রমিক কাজ করতো। দৈনিক ১০ হাজারেরও বেশি পোশাক তৈরি হতো। টাকার অংকে বলতে গেলে প্রতিদিন ২০ হাজার ডলারের বেশি পোশাক তৈরি হতো। ব্যাংক খেলাপির কারণেই মূলত আমাদের কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আমাদের প্রত্যেক শ্রমিকের বকেয়া বেতন পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি এমএ শাহীন জানান, নারায়ণগঞ্জে যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, এসব কারখানার বেশিরভাগ শ্রমিক বেঁচে থাকার জন্য এখন অটোরিকশা চালাচ্ছেন। কিছু শ্রমিক গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। আবার কিছু সংখ্যক শ্রমিক দিনমজুরের পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
‘অন্তর্বর্তী সরকার আসার কারণেই বিভিন্ন পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বিষয়টি তা নয়। কয়েকটি কারখানা আগে থেকেই বন্ধ হওয়ার উপক্রম ছিল। বিগত সরকারের আমল থেকেই কারখানাগুলো দুর্বল অবস্থায় ছিল। এর মূল কারণ যদি বলতে হয় তা হলো ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ।’
কারখানা বন্ধের কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অর্ডার কমে গেছে। কয়েকটি কারখানার মালিকপক্ষ আওয়ামীপন্থি। এসব কারণে বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
পোশাক কারখানা বন্ধের বিষয়ে শিল্পাঞ্চল পুলিশ-৪ নারায়ণগঞ্জ জোনের পরিদর্শক (গোয়েন্দা) সেলিম বাদশা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। তবে বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি অনেক কারখানা নতুন করে উৎপাদনে গেছে। কোনো কোনো কারখানায় কাজের চাপ কম রয়েছে।’
বিভিন্ন কারণে গত এক বছরে কয়েকটি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলার উপ-মহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র ঘোষ।
তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে সবসময় চেষ্টা থাকে কোনো কারখানা যেন স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে না যায়। এতে অনেক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন: পরিবেশবান্ধব লিড সনদ পেল আরও ৩ পোশাক কারখানাদশ মাসে বন্ধ ৪১ কারখানা, ধস নেমেছে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও বাসা ভাড়ায়৫ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২১.৬ শতাংশটাকা পাচার করায় কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে, এজন্য আমি দায়ী নাবাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোরশেদ সারোয়ার সোহেল বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার আসার কারণেই বিভিন্ন পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বিষয়টি তা নয়। কয়েকটি কারখানা আগে থেকেই বন্ধ হওয়ার উপক্রম ছিল। বিগত সরকারের আমল থেকেই কারখানাগুলো দুর্বল অবস্থায় ছিল। এর মূল কারণ যদি বলতে হয় তা হলো ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পোশাক খাতের এই সমস্যা শুরু হয়েছে মহামারি করোনা সময়কাল থেকেই। ব্যাংকের সুদহার বেড়ে গেলো, অর্ডার কমতে থাকায় কারখানাগুলো দুর্বল হতে লাগলো। ৫ আগস্টের পর এই ধাক্কা সারাদেশে পড়লে অর্ডার আরও কমে যায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতির পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সবমিলিয়ে কারখানাগুলোর আরও নাজুক অবস্থা তৈরি হলে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।’
বায়ার না পাওয়া, আর্থিক সংকট ও বিভিন্ন সিন্ডিকেটের কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু।
তিনি বলেন, ‘কিছু মালিক পতিত সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তারাও আত্মগোপনে চলে গেছেন। এসব সমস্যার কারণে লাস্ট কয়েক মাসে নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে একজন শ্রমিক বেকার হওয়ার পাশাপাশি তার পরিবারের সদস্যরাও সমস্যার মুখে পড়েছেন। সরকারের উচিত, বাইরে থেকে যে শক্তিগুলো শিল্প-কলকারখানা বন্ধ করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিতে কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থানে যাওয়া।’
এসআর/জেআইএম