২০২৫ সালের আগস্ট মাসে সুইডেনের কিরুনা শহরে একটি অভূতপূর্ব ও বিশ্বব্যাপী সংবাদজগতে আলোচিত ঘটনা ঘটেছে। কিরুনা চার্চ, যা ১৯১২ সালে স্থাপিত এবং আর্কিটেক্ট গুস্তাফ উইকম্যানের ডিজাইনে নির্মিত, ৫ কিলোমিটার দূরত্বে নতুন অবস্থানে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই স্থানান্তর কেবল শারীরিক নয়, বরং কিরুনা ও সুইডেনের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে সংরক্ষণের এক অনন্য প্রয়াস।
কিরুনা চার্চ প্রায় ১,৬০০ বর্গমিটার আয়তনের কাঠের স্থাপনা, যার আর্কিটেকচারে সামি সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। চার্চটি শুধুমাত্র ধর্মীয় স্থান নয়, বরং কিরুনার শহরবাসীর জন্য একটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রতীক। এটি সুইডেনের সবচেয়ে সুন্দর এবং প্রিয় কাঠের চার্চগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত।
স্থানান্তরের কারণকিরুনার মূল শহর এলাকা ধীরে ধীরে সম্প্রসারণশীল LKAB জাহাজ খনির কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত। তাই চার্চটি সরিয়ে নতুন শহরের কেন্দ্রের নিকটবর্তী নিরাপদ স্থানে রাখা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
স্থানান্তরের প্রক্রিয়া৬৭২ টন ওজনের চার্চকে বিশেষভাবে নির্মিত ট্রেলারে স্থাপন করা হয়। ২৪ মিটার প্রশস্ত রাস্তা ধরে, ঘণ্টায় মাত্র ০.৫ কিলোমিটার গতিতে স্থানান্তর করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি প্রায় ১৬–১৮ ঘণ্টা সময় নেয়। এই জটিল প্রকল্পটি উচ্চ প্রযুক্তি ও নিখুঁত পরিকল্পনার ফলাফল।
এই ঐতিহাসিক স্থানান্তরে সুইডিশ রাজা নিজে উপস্থিত ছিলেন এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রচার ও লাইভ সম্প্রচারের মাধ্যমে এটি বিশ্বব্যাপী খবরের শিরোনাম হয়ে উঠেছে। সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে বিজ্ঞান ও স্থাপত্য সংক্রান্ত চ্যানেল পর্যন্ত সবাই এই ঘটনাকে প্রশংসা করেছে।
উৎসব এবং সামাজিক উদযাপনচার্চ স্থানান্তর কেবল প্রযুক্তিগত কৃতিত্ব নয়, বরং একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবেও উদযাপিত হয়েছে। হাজারো মানুষ রাস্তার পাশে উপস্থিত ছিলেন, লাইভ সম্প্রচার চলছিল এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দর্শকরা সরাসরি অনুষ্ঠানটি দেখতে পেয়েছিলেন। স্থানান্তরের সময় চার্চক্যাফে অনুষ্ঠিত হয় এবং জনপ্রিয় শিল্পী যেমন Carola এবং KAJ অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
সামি সংস্কৃতির সংরক্ষণনতুন অবস্থানে চার্চটি সামি ভাষায় সেবা প্রদান শুরু করবে। এটি সুইডিশ চার্চের সাংস্কৃতিক সংহতি এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যকে সমর্থন করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনাস্থানান্তরের পর চার্চটি পুনঃস্থাপনা ও সংস্কারের মাধ্যমে নতুন অবস্থানে সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৬ সালের শেষের দিকে চার্চ পুনরায় খোলা হবে। কিরুনার পুরো শহরের স্থানান্তর প্রক্রিয়াটি ২০৩৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্য রয়েছে।
কিরুনা চার্চের স্থানান্তর একটি বিরল উদাহরণ, যা দেখায় কীভাবে প্রযুক্তি, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং রাজ্যগত সমর্থন একত্রিত হয়ে শহরের ইতিহাস সংরক্ষণ করতে পারে। এটি শুধু একটি ভবন সরানোর ঘটনা নয়, বরং কিরুনা এবং সুইডেনের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার রক্ষার এক প্রতীকী উদ্যোগ।
রহমান মৃধা গবেষক ও লেখক (সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন) Rahman.Mridha@gmail.com
এমআরএম/এমএস