গত ৭ আগস্ট জাগো নিউজে প্রকাশিত ‘যবিপ্রবি’তে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় পুরোনো সিন্ডিকেট’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. আহসান হাবীব।
১৯ আগস্ট পাঠানো এক প্রতিবাদলিপিতে তিনি দাবি করেছেন, ল’ অফিসার নিয়োগ, আপন ভাইপো, ভাগনি, মামাতো বোনসহ বেশ কিছু আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতজনদের অনিয়ম ও অর্থ-বাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ-বাছাই বোর্ডের কোনো সদস্য না হওয়ায় যেসব নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, তার সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধি-বিধান অনুসরণ করেই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন রেজিস্ট্রার আহসান হাবীব।
রেজিস্ট্রারের ভাষ্য, ‘উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ন্যায় দেশের যোগ্যতাসম্পন্ন সব নাগরিকই আবেদন করার সুযোগ পান। তবে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমার আত্মীয় বা পরিচিতজন হলে যে কেউ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবেন না বা নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারবেন না এমন কোনো আইন দেশের সংবিধান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বা অন্য কোনো বিধি-বিধানে আছে বলে আমার জানা নেই।’
রেজিস্ট্রার আহসান হাবীব বলেছেন, গত ২২ আগস্ট যবিপ্রবিতে ‘ল অফিসার’ হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ল অফিসার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত মাহমুদ আশরাবী নিশানের বাবা অ্যাডভোকেট তজিবর রহমান আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু উক্তিটি মিথ্যা ও বানোয়াট। তিনি যবিপ্রবির লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করেছিলেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজের সূত্রে যতটুকু পরিচিত হওয়া প্রয়োজন ততটুকু পরিচিত।
সহকারী রেজিস্ট্রার (লিগ্যাল) পদে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে আহসান হাবীবের ভাষ্য, তার (সহকারী রেজিস্ট্রার) নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয় বলে তার যোগ্যতা অনুযায়ী পদ নির্ধারণ করে নিয়োগ দেওয়ার যে উক্তিটি করা হয়েছে সেটিও সম্পূর্ণ বানোয়াট। সহকারী রেজিস্ট্রার (লিগ্যাল) পদে উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও কোনো যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড সহকারী রেজিস্ট্রার (লিগ্যাল) পদের বিপরীতে ল’ অফিসার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, নিয়োগ-বাছাই বোর্ডের সুপারিশ এবং রিজেন্ট বোর্ডের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে উক্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে বলে আমি মনে করি না।
প্রতিবাদলিপিতে তিনি আরও বলেন, ‘আমার কোনো মামাতো বোন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছে বলে আমার জানা নেই। আমার ভাইপো, যে ঢাকা নটরডেম কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে যথেষ্ট মেধার স্বাক্ষর রেখে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রচলিত নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে কর্মকর্তা পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়। বর্তমানে সে আর এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নেই।’
ভাগনির নিয়োগ প্রসঙ্গে রেজিস্ট্রার আহসান হাবীব বলেন, ‘আমার ভাগনি ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রচলিত নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়। পরে উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পূর্বে সে জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিল।’
তিনি বলেছেন, এসব নিয়োগে যে অনিয়ম ও অর্থ-বাণিজ্যের অভিযোগ আনা হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। সম্পূর্ণ অমূলক ও ভিত্তিহীনভাবে এই সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে। সিন্ডিকেট নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকার লুটপাটের যে অভিযোগ করা হয়েছে তা প্রতিবেদকের মনগড়া বক্তব্য বলেও দাবি করেন রেজিস্ট্রার। তিনি বলেছেন, টেন্ডার বা নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকায় এ অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ বা ভিত্তি আছে বলে আমি করি না।
প্রতিবাদলিপিতে আহসান হাবীব উল্লেখ করেছেন, ‘আমার ছেলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোনো পদে সে আবেদন করেনি। বর্তমানে সে স্বনামধন্য একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সম্মানজনক বেতনে চাকরিরত।’
যবিপ্রবি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপাচার্যের সাবেক পিএস কামরুল হাসানের বিষয়েও যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, সেটিও মনগড়া বক্তব্য, যার কোনো ভিত্তি নেই বলে দাবি করেছেন তিনি। এ বিষয়ে আহসান হাবীবের ভাষ্য, একজন জুনিয়র সহকর্মী হিসেবে তার প্রতি আমার যথেষ্ট স্নেহ ও শুভকামনা রয়েছে।
আরও পড়ুন যবিপ্রবিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় পুরোনো সিন্ডিকেটতিনি আরও বলেছেন, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক কার্যক্রমের নির্দেশনা বাস্তবায়নের কাজ রেজিস্ট্রার করে থাকে। এটা একটা সাধারণ বিষয়। আমার নেতৃত্বে সিন্ডিকেট সৃষ্টি করার যে বক্তব্য বারবার বলার চেষ্টা করা হয়েছে এবং আমার বিরুদ্ধে কথিত যে সিন্ডিকেট তৈরির অভিযোগ করা হয়েছে, সেই কথিত সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে আমি নিয়মবহির্ভূত কী কী কাজ করেছি বা ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য আমি কী কী কার্য সম্পাদন করেছি, সে সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান না করে সম্পূর্ণ মানহানি করার অভিপ্রায়ে মনগড়া এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।
প্রতিবাদলিপির শেষে রেজিস্ট্রার দাবি করেন, কতিপয় কুচক্রিমহল আমার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলে স্বীয় উদ্দেশ্য হাসিলের পাঁয়তারা করছে। একইসঙ্গে আমার কর্মস্থল যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে।
প্রতিবেদকের ভাষ্য
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের অভিযোগ এবং তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সংবাদটি তৈরি করা হয়েছে। সংবাদে ব্যক্তিগত কোনো মন্তব্য প্রকাশিত হয়নি।
রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবিব যে দুজন উপাচার্যের অধীনে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের দুজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে। এরমধ্যে একজন উপাচার্য দুদকের একাধিক মামলায় কারাগারে রয়েছেন। রেজিস্ট্রার-উপাচার্যদ্বয়ের সেসব কর্মকাণ্ডের সহযোগী বলে অভিযোগকারীদের দাবি।
প্রতিবাদলিপিতেও রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. আহসান হাবীব নিজেই উল্লেখ করেছেন, ‘রেজিস্ট্রারকে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করতে হয়, সেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড এবং উপাচার্যের গৃহীত নির্দেশনা মোতাবেক সকল সিদ্ধান্ত প্রতিপালনে রেজিস্ট্রারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।’
প্রতিবাদলিপি অনুযায়ী, সহকারী রেজিস্ট্রার (লিগ্যাল) পদে উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে একজন যোগ্য প্রার্থীও পাওয়া যায়নি। এরপর সহকারী রেজিস্ট্রার (লিগ্যাল) পদের বিপরীতে ল’ অফিসার পদে লিগ্যাল অ্যাডভাইজারের ছেলেকেই যোগ্যপ্রার্থী হিসেবে পাওয়া গেছে। এই ব্যাখ্যাও যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি করে। বাবা লিগ্যাল অ্যাডভাইজার, ছেলে ল’ অফিসার—এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে বাবা যবিপ্রবি থেকে পদত্যাগও করেন। লিগ্যাল অ্যাডভাইজার রেজিস্ট্রারের বন্ধু বলে ক্যাম্পাসে প্রচার রয়েছে। প্রতিবাদলিপিতে ভাইপো-ভাগনির চাকরির বিষয়টি স্বীকার করলেও যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়েছে বলে দাবি করেছেন। আর সেকশন অফিসার জেসমিন সুলতানা বলে থাকেন রেজিস্ট্রার ও তিনি মামাতো-ফুপাতো ভাইবোন। ‘ছেলের চাকরির জন্য প্রক্রিয়া চললেও’ সংবাদ প্রকাশের পর সেটি থমকে যান বলে সূত্র জানিয়েছে।
আনুষ্ঠানিক সমাবেশে রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে যবিপ্রবি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপাচার্যের সাবেক পিএস কামরুল হাসানের বক্তব্য এখনো ফেসবুক পেজে রয়েছে। যে কারণে তাকে রোষানলে পড়তে হয়েছে। যবিপ্রবিতে উপাচার্যের নিয়োগের সময় অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট যে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল, তার ব্যত্যয় হয়েছে বলে দাবি অভিযোগকারীদের। এক্ষেত্রে প্রতিবাদলিপিতে সুনির্দিষ্টভাবে শর্ত পূরণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে উপাচার্য বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আর প্রতিবাদলিপিতে এ নিয়োগে নিয়মের ব্যত্যয়ের প্রতিবাদ করা হয়নি। বরং অভিযোগ থাকলে তা কর্তৃপক্ষ বরাবর করা হয়নি বলে দাবি করা হয়েছে। সর্বোপরি যবিপ্রবিতে অনিয়ম, দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ, মামলাসহ নানা বিতর্ক চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। সেখানেই প্রশাসনিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীব। এছাড়া প্রতিবেদনটি তৈরির সময় রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীবকে একাধিকবার ফোন করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ না করায় খুদে বার্তা পাঠিয়ে পরিচয় উল্লেখ করে বক্তব্যের জন্যও অনুরোধ জানানো হয়। এরপরও তিনি ফোন ধরেননি বা কোনো বক্তব্য দেননি।
মিলন রহমান/এসআর/জিকেএস