যবিপ্রবিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় পুরোনো সিন্ডিকেট

মিলন রহমান মিলন রহমান , জেলা প্রতিনিধি, যশোর
প্রকাশিত: ১১:৪৭ এএম, ০৭ আগস্ট ২০২৫
ফাইল ছবি

• অবসরে যাওয়া রেজিস্ট্রারকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ
• পাঁচ মাসেও কাজ শুরু করেনি তদন্ত কমিটি
• পদে বহাল চার্জশিটভুক্ত আসামি উপ-পরিচালক

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) সেই সময়ের সিন্ডিকেট ফের সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। চক্রটি বিগত আওয়ামী লীগ আমলে অর্গানোগ্রাম (টিওঅ্যান্ডই) অনুমোদন ছাড়াই আইন লঙ্ঘন করে যেসব নিয়োগ হয়েছে, সেগুলোরও বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

বিগত সময়ের উপাচার্যদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত সিন্ডিকেটের অন্যতম নিয়ন্ত্রক যবিপ্রবি রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীব অবসরে গেলেও তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা হয়েছে। তাকে ঘিরে কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা পুরোনো সিন্ডিকেট সক্রিয় করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে যবিপ্রবির একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে যবিপ্রবিতে বিগত সময়ের নিয়োগ বাণিজ্য ও অনিয়ম তদন্তে গঠিত কমিটি পাঁচ মাসেও কাজ শুরু করতে পারেনি। ফলে ওই চক্রটির চেষ্টা সফল হলে যবিপ্রবিতে সরকারের বিপুল আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। একইসঙ্গে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, চার্জশিটভুক্ত আসামির দায়িত্বে বহাল এবং অনুমোদনহীন পদে নিয়োগের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে।

যবিপ্রবি সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বের অনুমোদিত অর্গানোগ্রাম (টিওঅ্যান্ডই) ২০১৯-২০ অর্থবছরে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। এরপর যবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) নতুন প্রস্তাবিত অর্গানোগ্রাম অনুমোদনের জন্য জমা দেয়। ইউজিসি প্রস্তাবিত অর্গানোগ্রাম পর্যালোচনা করে সুপারিশসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে পাঠায়। এরপর প্রস্তাবিত সংশোধিত অর্গানোগ্রামটি যবিপ্রবি উপাচার্য বরাবর ফেরত পাঠানো হয়। ফলে সেই সময় অর্গানোগ্রামটি অনুমোদন হয়নি। আর অর্গানোগ্রাম অনুমোদন ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগের সুযোগ নেই।

কিন্তু তারপরও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ চার বছর ধরে যবিপ্রবিতে অর্গানোগ্রাম বহির্ভূত একের পর এক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের মহোৎসব চলেছে। এসব নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও অর্থবাণিজ্যের অভিযোগও ছিল বিস্তর। পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও বিস্তর অনিয়ম করা হয়েছে।

সূত্র অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ২২ আগস্ট যবিপ্রবিতে ল’ অফিসার হিসেবে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও যোগদানপত্র অনুযায়ী তাকে সহকারী রেজিস্ট্রার (লিগ্যাল) পদের বিপরীতে অস্থায়ী নিয়োগ দেখানো হয়। ওই পদে নিয়োগপ্রাপ্ত মাহমুদ আশরাবী নিশানের বাবা অ্যাডভোকেট তজিবর রহমান যবিপ্রবি রেজিস্ট্রারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং যবিপ্রবির লিগ্যাল অ্যাডভাইজার ছিলেন। সহকারী রেজিস্ট্রার (লিগ্যাল) পদে তার নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয় বলে তার যোগ্যতা অনুযায়ী পদ নির্ধারণ করে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ঘটনার পর বিতর্ক সৃষ্টি হলে ছেলের ল’ অফিসারের চাকরি বহাল রাখতে অ্যাডভোকেট তজিবর রহমান লিগ্যাল অ্যাডভাইজার পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

এছাড়াও রেজিস্ট্রারের আপন ভাইপো, ভাগ্নি, মামাতো বোনসহ বেশকিছু আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতজনদের অনিয়ম ও অর্থবাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে যবিপ্রবিতে অবৈধভাবে নিয়োগের মাধ্যমে ৬১ লাখ ৩১ হাজার ৭৩২ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট যবিপ্রবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুস সাত্তার, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) সাবেক উপ-উপাচার্য ড. কামাল উদ্দিন এবং উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আব্দুর রউফের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়। উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আব্দুর রউফের নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় এই মামলা দায়ের করা হয়। গত ১৬ জুন’২৫ এই মামলায় যবিপ্রবির সাবেক উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. আব্দুস সাত্তারকে কারাগারে পাঠান আদালত।

তবে ২০০৯ সালে অবৈধভাবে ওই নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগে দুদকের মামলায় নিয়োগকর্তা সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুস সাত্তার কারাগারে গেলেও ‘অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া’ কর্মকর্তা আব্দুর রউফ এখনও দায়িত্বে বহাল রয়েছেন। অথচ চাকরি বিধি অনুযায়ী, চার্জশিটভুক্ত হওয়ায় তাকে সাময়িক বহিষ্কার করার কথা। যবিপ্রবির লিফট কাণ্ডের অন্যতম হোতাও উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আব্দুর রউফ।

এ ব্যাপারে দুদকের আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম বলেন, দুদকের এই মামলায় আব্দুর রউফও চার্জশিটভুক্ত আসামি। আর দুদকের মামলায় চার্জশিটভুক্ত হলে সার্ভিস রুল অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্তের বিধান রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, বিগত আওয়ামী লীগ আমলের সর্বশেষ দুই উপাচার্য নিয়োগ, আপগ্রেডেশন ও প্রমোশনে নিজেদের খেয়াল খুশিমতো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে পছন্দ মতো রিজেন্ট বোর্ড ছিল সব অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করার প্রধান অস্ত্র। আর ওই উপাচার্যদের সহায়ক শক্তি ছিলেন উপাচার্যদের ঘনিষ্ঠজন রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীব। যদিও তার নিয়োগ নিয়েও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। ২০১১ সালের যে বিজ্ঞপ্তিতে তিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন, সেই বিজ্ঞপ্তিতেও অভিজ্ঞতার দু’টি শর্তেই প্রশাসনিক কার্য পরিচালনার ১০/১৫ বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত ছিল। অথচ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই তৎকালীন আওয়ামী লীগের এমপি খালেদুর রহমান টিটোর আস্থাভাজন হওয়ায় নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, গত এক যুগ ধরে যবিপ্রবিতে যে সিন্ডিকেট নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকার লুটপাট করেছে; সেই সিন্ডিকেটের অন্যতম রেজিস্ট্রার আহসান হাবিব। তার নিয়োগের পর দু’জন উপাচার্য পরিবর্তন হলেও তিনি স্বপদেই বহাল থেকেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, যেহেতু রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীব যবিপ্রবিতে দুই যুগ ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। এ কারণে বর্তমান উপাচার্যও বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য তার ওপর নির্ভর করছেন। এ কারণে গত মে মাসে রেজিস্ট্রার আহসান হাবীবের পিআরএল’এ যাওয়ার কথা থাকলেও তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রেও নিয়োগবিধি লঙ্ঘনেরও অভিযোগ উঠেছে। আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সুযোগে রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীবের নেতৃত্বে সেই পুরোনো সিন্ডিকেটটি সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে।

তবে এ ব্যাপারে বক্তব্যের জন্য যবিপ্রবি রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীবকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। বক্তব্যের জন্য ক্ষুদে বার্তা দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।

যবিপ্রবি সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, বিগত সময়ে যবিপ্রবির ‘লাগামহীন নিয়োগ-অনিয়ম ও বাণিজ্যের’ বিষয়টি আমলে নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। যবিপ্রবির প্রথম উপাচার্য প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম সরকারকে প্রধান করে এই কমিটি গঠনের পর পাঁচ মাস পার হলেও কমিটি এখনও কাজ শুরু করেনি।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তদন্ত কমিটির প্রধান যবিপ্রবির প্রথম উপাচার্য প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম সরকার বলেন, সম্প্রতি তিনি তদন্ত কমিটির কাগজপত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন উল্লেখ করে তিনি আর বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি।

তবে এ ব্যাপারে যবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মজিদ জানান, গত ফেব্রুয়ারি মাসে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিগত সময়ের নিয়োগ বাণিজ্য, অনিয়ম, দুদকের মামলা বা অনুমোদনহীন নিয়োগের বিষয়টিগুলো তদন্ত কমিটি দেখবে। কমিটি কাজ করছে; তবে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, দুদকের মামলার আসামি আব্দুর রউফের ব্যাপারে কী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আর ল’ অফিসার নিয়োগের বিষয়টিও ওই তদন্ত কমিটি দেখবে।

এছাড়া রেজিস্ট্রারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রেজিস্ট্রার নিয়োগের ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক কার্যক্রমে যাতে ছেদ না পড়ে এজন্য রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীবকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি উল্লেখ করেন, কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিকে তিনি প্রশ্রয় দেবেন না।

এফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।