ফারহানা আক্তার
২০২৪ সালটি বাংলাদেশের জন্য ছিল দুর্যোগের বছর। আগস্টে ভারত থেকে প্রবাহিত পানির কারণে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ ১১টি জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। এতে প্রায় ৫.৮ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং প্রাণহানি ঘটে অনেক। বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়।
শুধু বন্যা নয়, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে তাপপ্রবাহের তীব্রতাও ছিল অনেক। এমন তাপমাত্রার কারণে সরকার বাধ্য হয়ে স্কুল বন্ধের মতো পদক্ষেপও নেয়। সে বছর মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। এই ঝড়ের কারণে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রায় ৩.৭৫ লাখ মানুষ প্রভাবিত হন।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকা খুলনা বিভাগের বিভিন্ন গ্রামে মানুষ প্রতিনিয়ত দুর্যোগ, জলাবদ্ধতা, নদীভাঙন ও নিরাপদ পানির সংকটে ভুগছে।
খুলনাকেন্দ্রীক একটি অলাভজনক সংস্থায় কাজ করার সুবাধে সুযোগ হয়েছে এখানকার প্রান্তিক মানুষজনের সঙ্গে মেশার। খুব কাছ থেকে দেখেছি খুলনার প্রাণ-প্রকৃতি, জীব বৈচিত্র্য আর জলবায়ু। খুলনার নড়াইল, কেশবপুর, বানিশান্তা, লস্কারপুর এলাকায় গেলে আমার চোখ আটকায় নানা সমস্যায়। দেখেছি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কীভাবে ভাগ্যের মন্দ পরিবর্তন হতে চলেছে খুলনা বিভাগের মানুষের। এছাড়া আমার সংগঠন অধিকার, জীবিকা, জলবায়ু পরিবর্তন, সহিংসতা নিয়ে কাজ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ছে খুলনার মানুষের।
গত সপ্তাহে রেখামারি গ্রামে বসবাসরত নাসিমা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। স্বামী ও সন্তান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রান্তিক জীবনে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। প্রতি বছরই তিনি ঝড়-বন্যার কারণে নতুন ঘর তৈরি করেন, কিন্তু তা স্থায়ী সমাধান হয়ে ওঠে না। ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বাড়লে তাকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিতে হয় পরিবারটির। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া পর্যন্তও নানা বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়।
খুলনায় হেঁটে দেখেছি, বানিশান্তা ইউনিয়নের এই অঞ্চল সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে হলেও এখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত লড়ছে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে। বছরের ৪-৬ মাস ঝড় ও বন্যার কারণে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও চলাচলের উপযুক্ত রাস্তার অভাব মানুষকে নিত্য কষ্টে রাখছে। বর্ষা মৌসুমে ঝুলন্ত টয়লেট, একই স্থানে থালা-বাসন ধোয়া, গোসল ও কাপড় কাচা দৃশ্যমান, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে।
যশোরের কেশবপুরে প্রতিবছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। স্থানীয় মানুষদের নিজস্ব ঘর ছেড়ে রাস্তায় বসবাস করতে হয়। কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাতায়াতে সমস্যা হয় এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেল, শ্রীমান্তকাঠি গ্রামের মানুষ প্রতিদিন সুপেয় পানির জন্য সংগ্রাম করছে। অনেকেই নানা রোগ, এমনকি ক্যানসারের মতো জটিল অসুখে ভুগছে, যার উৎস তারা বুঝতে পারছে না।
কিছু এনজিও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি। নড়াইলের মাইজপাড়া ইউনিয়নেও সম্প্রতি জলাবদ্ধতার সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই জলাবদ্ধতার কারণে সাপের উপদ্রবও বেড়েছে। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত থাকায় পানি নিষ্কাশনের সমস্যা তৈরি হয়েছে, এর সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে নারী ও শিশু। মানুষের চলাচল, কৃষিকাজ ও সাধারণ কার্যক্রম প্রায় ব্যাহত হয়ে পড়েছে, যা জনজীবনে অতিরিক্ত দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। যদিও পানি এখন অনেকটা নেমে এসেছে কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিরিক্ত ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে, যা অপুষ্টি, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া ও তাপমাত্রাজনিত স্ট্রেসের কারণে হবে। ডব্লিউইএফ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন ২০৫০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ১৪.৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু এবং ১২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি করতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ান একটি গবেষণা সংস্থা ২০১৮ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়, যদি বিশ্বে বর্তমান কার্বন নিঃসরণ প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ মিটার বৃদ্ধি পাবে, আমাজন বনাঞ্চল ধ্বংস হবে এবং গ্রীষ্মকালে ২০ দিনের বেশি তাপমাত্রা ৫ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণে সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি। প্রথমত, টেকসই বাঁধ, সেচ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিরাপদ পানির উৎস বৃদ্ধি ও সুপেয় পানি সংরক্ষণে কার্যকর প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। তৃতীয়ত, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় জলবায়ু-সহনশীল কৃষি, বিকল্প জীবিকা ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো গেলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব। এছাড়া নিজেদের আরও সচেতন এবং যত্নবান হতে হবে নিজের এবং পরিবেশের প্রতি।
আরও পড়ুন
মাদকের ভয়াল ছোবলে শিশু-কিশোর কিশোর অপরাধ: সভ্যতা যেন দেউলিয়ার পথেলেখক: উন্নয়নকর্মী
কেএসকে/এমএস