একুশে বইমেলা

হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘১৯৭১’: অনন্য সৃষ্টি

বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হ‌ুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২)। তাঁর অসংখ্য রচনার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘১৯৭১’-কে বিশেষভাবে লিখে গেছেন। যদিও বইটি পুরোপুরি ঐতিহাসিক দলিল নয়। তবুও মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতাকে গ্রামীণ জীবনের মধ্য দিয়ে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসে যুদ্ধক্ষেত্রের সরাসরি সংঘর্ষ নেই। আছে যুদ্ধের ভয়, আতঙ্ক, বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মত্যাগ এবং মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনি।

কাহিনি ও পটভূমি‘১৯৭১’-এর গল্প গড়ে উঠেছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম নীলগঞ্জকে ঘিরে। দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন এই জনপদে পাকিস্তানি সেনারা এসে স্কুলঘর দখল করে। গ্রামের শান্ত, দরিদ্র, নিরুপদ্রব মানুষদের জীবনে হঠাৎ প্রবেশ করে যুদ্ধের বিভীষিকা।

মেজর এজাজ আহমেদ, পাকিস্তানি সেনাদের কমান্ডার, স্থানীয়দের ওপর দমননীতি চালিয়ে যায়। তাকে সহযোগিতা করতে দেখা যায় রফিক নামের এক তরুণকে। প্রথমে মনে হয়, রফিক বিশ্বাসঘাতক। কারণ সে মেজরকে সাহায্য করছে, গ্রামবাসীর খবর দিচ্ছে। কিন্তু ক্রমে প্রকাশ পায়, রফিক আসলে মুক্তিবাহিনীর গোপন সহায়ক; সে পাকিস্তানিদের তথ্য গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়লেও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রফিক ভয় পায় না। বরং দৃপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘মেজর সাহেব, আমার মনে হয় আপনি জীবিত ফিরে যাবেন না এ দেশ থেকে।’

চরিত্র বিশ্লেষণরফিক: উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তার দ্বৈত ভূমিকা পাঠককে প্রথমে বিভ্রান্ত করে। পাকিস্তানিদের সহযোগী মনে হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি বীরত্বের প্রতীক।

মেজর এজাজ: নিষ্ঠুরতা, অহংকার ও মানববিদ্বেষের প্রতিচ্ছবি। তার উক্তি ‘মানুষকে ভয় পাইয়ে দেবার একটা আলাদা আনন্দ আছে’। যা পাকিস্তানি সেনাদের মানসিকতার নিদর্শন।

মীর আলি ও বদি: গল্পের শুরুতে এলেও বড় কোনো ভূমিকা নেই। তবে অন্ধ মীর আলিকে দেখে মেজরের নিজের অন্ধ বাবার কথা মনে পড়া এক মানবিক মুহূর্ত। যা দেখায় নিপীড়কও কোথাও না কোথাও মানুষ।

আজিজ মাস্টার, সফরউল্লাহ, কৈবর্ত মনা: সাধারণ গ্রামবাসী, যারা প্রথমে ভীরু ও অসহায় মনে হলেও শেষ পর্যন্ত অন্যায়ের প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে যান। আজিজ মাস্টারের মরতে প্রস্তুত হওয়া কিংবা সফরউল্লাহর প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে যাওয়া মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি প্রকাশ করে।

আরও পড়ুনমৃত্যুক্ষুধা: সাম্যবাদী চেতনার উপন্যাসকবিতার করতলে: বহুরৈখিক নকশার দলিল

যুদ্ধের বাস্তবতা ও প্রতীকীউপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের বৃহৎ ইতিহাস নেই কিন্তু যুদ্ধ কীভাবে সাধারণ মানুষকে বদলে দেয়, তা জীবন্তভাবে দেখানো হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা, মা-বোনদের ওপর নির্যাতন, নিরীহ মানুষকে হত্যা—সব মিলিয়ে গ্রামবাংলার এক রুদ্ধশ্বাস চিত্র উঠে এসেছে।

অন্ধ মীর আলি ও পাগল নিজাম—এই দুই চরিত্র যুদ্ধের বিশৃঙ্খলার মধ্যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। লেখক বুঝিয়েছেন, পাগল বা অন্ধ বলে মনে হলেও তারা ভেতরে ভেতরে যুদ্ধের অস্বাভাবিকতাকে অনুভব করতে পারেন।

হ‌ুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যশৈলীহ‌ুমায়ূন আহমেদ সব সময়ই সংলাপনির্ভর ও সহজবোধ্য লেখনী ব্যবহার করেছেন। ‘১৯৭১’-এও তার ব্যতিক্রম নেই। উপন্যাসে মাঝেমধ্যে হালকা মজা, মানুষের সূক্ষ্ম আচরণের চিত্রায়ণ আছে। তবে পুরো গল্পে ভয়ংকর পরিস্থিতি, অনিশ্চয়তা ও প্রতিরোধের সুর তীব্র।

পাঠকের জন্য শিক্ষা‘১৯৭১’ উপন্যাসটি পড়লে আমরা বুঝতে পারি, যুদ্ধ শুধু বন্দুকের সংঘর্ষ নয়, এটি মানুষের আত্মসম্মান, বেঁচে থাকার অধিকার আর ন্যায়ের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়ার সংগ্রাম। হ‌ুমায়ূন আহমেদ দেখিয়েছেন, সাধারণ মানুষও প্রয়োজনে বীর হয়ে ওঠে। রফিকের মতো যুবকের আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দেশের স্বাধীনতা কোনো ব্যক্তিগত অর্জন নয়। এটি কোটি মানুষের রক্ত-ঘাম-অশ্রুর ফল।

‘১৯৭১’ নিছক ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ নয়; এটি এক গ্রামের মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মনস্তত্ত্বের প্রতিচ্ছবি। এখানে ভীরুতা আছে কিন্তু আছে ঘুরে দাঁড়ানোও। আছে বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া, আবার আছে আত্মত্যাগের অগ্নিশিখা।

বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে বইটি শুধু সাহিত্য নয়, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। যে কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করতে চান, মানুষের ভয় থেকে সাহসী হয়ে ওঠার গল্প জানতে চান। তাদের জন্য হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘১৯৭১’ অনন্য এক সৃষ্টি।

এসইউ/জেআইএম