রোজিনা আক্তার রোজী (৫৫) মহাসড়কের পাশে বসে পাট থেকে আঁশ ছাড়াচ্ছেন। এসেছেন সকাল ৮টায়, বাড়ি ফিরবেন বিকেল ৪টায়। এ সময়ের মধ্যে তিনি পাটের যে আঁশ ছাড়াবেন সবগুলোর পাটকাঠি তার। টানা ৮ ঘণ্টা কাজ শেষে যে পাঠকাঠি তিনি পাবেন, তার মূল্য ৪০০-৫০০ টাকা।
রোজী বলেন, ‘সারাবছর তাকিয়ে থাকি কখন পাটের আঁশ ছাড়ানোর সময় আসবে। ৭-৮ ঘণ্টা পাটের আঁশ ছাড়িয়ে যে পাটকাঠি পাই, তা যদি বিক্রি করি তাহলে ৪০০-৫০০ টাকা হয়। শুধু বিক্রি নয়, পাটকাঠি সারাবছর রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করি। এক-দেড় মাস পাটের আঁশ ছাড়ানোর কাজ হয়। এ সময়ের বাড়তি আয়ে সংসারের বেশ উপকার হয়।’
রোজীর মতো সোনালি আঁশের রুপালি কাঠি অনেক নারীর পরিবারে এনেছে সচ্ছলতা। গ্রামের নারীরা অন্যের পাটের আঁশ ছাড়ানোর বিনিময়ে যে পাটকাঠি নিচ্ছেন, তা বিক্রি করে সংসারের জন্য বাড়তি আয় করছেন। পাশাপাশি অনেকেই সারাবছরের জ্বালানি হিসেবে মজুত করছেন।
সরেজমিনে উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের সরাইকান্দি, মুলাডুলি, শ্রীপুর, নিকটহাটা, শেখপাড়া, দাশুড়িয়ার মারমী, সুলতানপুর, ডিগ্রীপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পাটের আঁশ ছাড়ানোর ধুম পড়েছে। অনেক নারী-পুরুষ পাটের আঁশ ছাড়ানো, ধোয়া ও শুকানোর কাজ করছেন।
উপজেলার সরাইকান্দীর পাবনা-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে পাট থেকে আঁশ ছাড়াচ্ছিলেন আয়েশা বেগম। তিনি বলেন, ‘পাট ছোলার কাজ (আঁশ ছাড়ানো) করছি পাটকাঠির জন্য। এসব পাটকাঠি রান্নার কাজে ব্যবহার করি।’
এখানকার অনেকেই আবার বিক্রি করেন। একই গ্রামের শ্রাবণী বিশ্বাস বলেন, ‘পাটকাঠির জন্য শুধু কাজ করছি। আমাদের কোনো হাজিরা নেই। কাজ শেষে পাটকাঠি বাড়িতে নিয়ে যাবো।’
আরও পড়ুনটাঙ্গাইলে পাট চাষে কৃষকের মুখে হাসিফরিদপুরে ‘সবুজ সোনা’ চাষে লাভবান কৃষকমুলাডুলি জোয়াদ্দার পাড়ায় পাটের আঁশ ছাড়ানোর কাজ করছিলেন শ্রীপুর গ্রামের আনিছা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে ১০-১২ জন নারী পাট ছোলার কাজ করছি। শোলা (পাটকাঠি) বাড়ির রান্নাবান্না ও শিমের ক্ষেতের মাচা তৈরির কাজে ব্যবহার করি।’
শেখপাড়া গ্রামের আকলিমা খাতুন বলেন, ‘প্রতিবছর এ টাইম আসলে পাট ছিলি (আঁশ ছাড়ানো)। পাটকাঠি রান্নার কাজের ব্যবহারের পাশাপাশি অনেকেই বিক্রি করে টাকা আয় করে।’
মুলাডুলির ইটভাটা এলাকার কাজে নিয়োজিত পুরুষ শ্রমিক বলেন, ‘প্রতি বছরই নারীরা পাট ছোলার (আঁশ ছাড়ানো) কাজ করে। তাদের ছোলা আঁশ আমরা ধোয়ার কাজ করি। আমরা মজুরি পেলেও তারা কোনো মজুরি পায় না বা চায় না। তারা শুধু পাটকাঠি নেয়।’
উপজেলার মুলাডুলি এলাকার ‘দেশসেরা স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ২০১৯’ পাট চাষি এনামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার পাট চাষ মোটামুটি ভালো হয়েছে। জাগ দেওয়া পাট মেয়েরা ছিলতেছে (আঁশ ছাড়াচ্ছে)। এটি শোলার বিনিময়ে ছিলতেছে। এরা এগুলো রান্না ও শিম গাছের মাচা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করে। আমরা যারা পাট চাষি রয়েছি, আমাদের মজুরি দেওয়া লাগছে না। নিজেদের সাশ্রয় হচ্ছে। পাশাপাশি পাটকাঠি নিয়ে নারীরাও লাভবান হচ্ছে।’
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মমিন বলেন, ‘ঈশ্বরদী উপজেলায় ৩৬০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। পাটের ফলন খুব ভালো হয়েছে। গতবার পানির অভাবে জাগ দিতে সমস্যা হয়েছিল। এবার প্রচুর বৃষ্টিপাতে এ সমস্যা নেই। পাট প্রসেসিংয়ের ক্ষেত্রে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। নারীরা পাটকাঠির বিনিময়ে প্রসেসিংয়ের কাজ করছেন। তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করতে পারছেন।’
এসইউ/জেআইএম