একুশে বইমেলা

এবার ক্ষতিগ্রস্ত হবেন লেখক-প্রকাশকরা

শফিক হাসান

বইমেলা নিয়ে বলার আগে নিজের অস্বস্তির কথাই বলি। এক বছরে দুটি একুশে বইমেলা ঠিক মানানসই মনে হলো না। সবচেয়ে বড় কথা, এই বইমেলার সঙ্গে আমাদের ভাষা আন্দোলনের অনুষঙ্গ জড়িত। ২০০৮ সাল থেকেই বইমেলায় যাচ্ছি। যেতে যেতে মাইকে একুশের গান ‌‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...’ শুনতাম। এটাকে মনে হতো বইমেলার অনিবার্য অংশ। এমন আয়োজনের মধ্য দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাতে পারতাম। তাদের ত্যাগ কতটা বিশাল, ভাষার গৌরব কতটা মহান, এমন ভাবনাও আমাদের চেতনায় কাজ করতো।

নিয়ম মেনে ফেব্রুয়ারি মাসেই বইমেলার আয়োজন করা যেত। রমজান মাস শুরু হতো ১৮ তারিখ থেকে। তার মানে অর্ধেকের বেশি সময় বইমেলা চলতো। এর পরে যারা বইমেলায় আসার, চাইলে কেউ কেউ আসতে পারতেন। বইমেলার মাঠেও বড় পরিসরে মাগরিব, এশা ও তারাবির নামাজের আয়োজন রাখা যেত। যারা নামাজ পড়ার পড়তেন। রাখা যেত সাশ্রয়ী মূল্যে ইফতারের আয়োজনও। তা না করে কী হলো?

নির্বাচনের জন্যও বইমেলা আগানো হলো। কিন্তু শেষপর্যন্ত ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন যদি না হয়! বইমেলা যেহেতু লেখক-পাঠক-প্রকাশকের; তাদেরও প্রস্তুতির ব্যাপার থাকে। কোনো কোনো লেখক ডিসেম্বরের পরে পাণ্ডুলিপি গোছান। ফাইনাল হলে তুলে দেন প্রকাশকের হাতে। প্রকাশক আনুষঙ্গিক কাজ করে বই প্রকাশের ব্যবস্থা করতেন। সেই বই বইমেলার স্টল হয়ে পৌঁছে যেত পাঠকের হাতে। এবার ‘একের ভেতর দুই’ তথা ‘চটজলদি বইমেলা’য় এই চেইনে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটবে। প্রকাশকরা যেমন সব বই আনতে পারবেন না, আবার লেখকেরাও সময়মতো লেখা শেষ করতে পারবেন না। বঞ্চিত হবেন পাঠক। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন লেখক-প্রকাশক উভয়ে। দর্শনার্থীরাও মন থেকে সাড়া পাবেন বলে মনে হয় না।

আরও পড়ুনসিলেটের নীলক্ষেত: রাজা ম্যানশন যেন বইয়ের খনি আশা-নিরাশার বইমেলা 

তাই বইমেলার কাছে প্রত্যাশা থাকবে, কোনো স্টল যেন বন্ধ না হয়। মতপ্রকাশের কারণে কেউ যেন হুমকির শিকার না হন। গালিগালাজ না শোনেন। মনে রাখতে হবে, এই মেলা সবার, সর্বজনীন। শুধু এক শ্রেণির বইমেলায় পরিণত হলে মেলার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। নির্দিষ্ট কোনো বই বা ব্যক্তি নিয়ে দ্বিমত থাকলে আমরা যেন লেখার মাধ্যমে সেটার জবাব দিই। লেখার জবাবে লেখা। গায়ের জোর দেখানোর মতো অসভ্যতা না করি।

বিগত বইমেলায় সিসিমপুর ছিল না। শিশুরা বঞ্চিত হয়েছে। এবার শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য যেন বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়। বইমেলার মূল প্রাঙ্গণে যেন চায়ের ব্যবস্থা থাকে। সর্বোচ্চ দশ টাকার মধ্যে চা ও বিশ টাকার মধ্যে নাস্তার আয়োজন রাখা দর্শনার্থীদের জন্য করুণা হবে না, এটা তাদের অধিকার। গলাকাটা দামের স্টল চাই না। যদি সেটা করতেই হয়, তারা অন্য কোথাও গিয়ে করুক। বইমেলায় নয়।

মনে রাখতে হবে, বই সংশ্লিষ্টদের অনেক অর্থকড়ি নেই। বইকে ভালোবাসলে ‘গরিব’ থেকে যেতে হয়। আর এই ‘গরিব’ মানুষদের ওপরে জোর-জুলুম কেন হবে? এ ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির প্রত্যক্ষ তদারকি প্রত্যাশা করি।

এসইউ/জিকেএস