স্বাস্থ্য

হৃদরোগের বাড়তি ঝুঁকিতে বাংলাদেশ, প্রতিরোধই প্রধান অস্ত্র

হৃদরোগ এখন এক ভয়ঙ্কর জনস্বাস্থ্য সমস্যা দেশের। ইউরোপ-আমেরিকায় যেখানে গড়ে ৬৫ বছর বয়সে প্রথম হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি দেখা দেয়, সেখানে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এই বয়সের সময়সীমা নেমে এসেছে ৫১-৫২ বছরে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এখন ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণরাও গুরুতর হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, অপরিকল্পিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং ধূমপানই হৃদরোগের প্রবণতা বাড়াচ্ছে।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ লাখ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ মারা যান হার্ট অ্যাটাক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে। হৃদরোগে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মৃত্যুহার বেশি, কারণ প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধার অভাব। ৪০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

আরও পড়ুন:

হৃদরোগ : প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়দেশে বছরে ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হৃদরোগেদেশে প্রতিবছর হৃদরোগে মারা যান ২ লাখ ৭৩ হাজার মানুষ

শহরের মতো গ্রামেও রোগটির বিস্তার বাড়ছে, অথচ জনগণের মধ্যে সচেতনতা এখনও পর্যাপ্ত নয়। চিকিৎসকরা মনে করেন, প্রতিরোধ ছাড়া এই রোগ নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই।

প্রতিরোধের উপায়

বিশেষজ্ঞদের মতে, হৃদরোগ প্রতিরোধে জীবনযাত্রায় ছোট ছোট পরিবর্তনই বড় ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা সপ্তাহে ১৫০ মিনিট শারীরিক ব্যায়াম, অতিরিক্ত লবণ-চিনি এড়িয়ে চলা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ডিম ও দুধ খাওয়া নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা দূর করে তারা বলেন, ডিমের কুসুম ও দুধ (সর ছাড়া) পরিমিত পরিমাণে খাওয়া নিরাপদ। তবে গরু বা খাসির মাংস খেলে অবশ্যই সীমিত পরিমাণে খেতে হবে এবং মাংসের ঝোল এড়িয়ে চলতে হবে।

চিকিৎসকরা আরও জানান, অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার অভ্যাস হৃদরোগের জন্য ভয়ঙ্কর। তাই রান্নায় কম লবণ ব্যবহার করতে হবে এবং আলাদা করে লবণ খাওয়ার প্রবণতা বাদ দিতে হবে। একইভাবে অতিরিক্ত ভাত ও চিনি ডায়াবেটিস সৃষ্টি করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।

তরুণদের বাড়তি ঝুঁকি

চিকিৎসকদের মতে, এখন সবচেয়ে উদ্বেগজনক প্রবণতা হলো, খুব কম বয়সী তরুণরা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছেন। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের সিসিইউতে প্রতিদিনই ২৫-৩০ বছর বয়সী রোগী ভর্তি হচ্ছে, যাদের অনেকে ধূমপায়ী। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান একাই তরুণদের হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ হতে পারে।

আরও পড়ুন:

হৃদরোগ প্রতিরোধে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার বন্ধ জরুরিহার্টের রোগীর চাপ বাড়ছে ঢাকায়, বাড়ছে না চিকিৎসার পরিসরবিশ্বে হৃদরোগে প্রতি দেড় সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ধূমপান ছাড়ার দুই বছরের মধ্যেই হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তাই ধূমপান ত্যাগ করাই হৃদরোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ ও করণীয়

চিকিৎসকদের মতে, বুকে তীব্র চাপ বা ব্যথা, যা চোয়াল, গলা, বাহু বা পিঠে ছড়িয়ে পড়ে, প্রচণ্ড ঘাম, বমি বমি ভাব এবং শ্বাসকষ্ট এসবই হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ। এমন পরিস্থিতি দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে যেতে হবে এবং ইসিজি করাতে হবে।

তারা বলেন, টাইম ইজ মাসেল, হার্ট অ্যাটাকের পর যত সময় যায়, তত বেশি হার্টের মাংসপেশি নষ্ট হয়। তাই সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা গেলে রোগীকে বাঁচানো এবং জটিলতা এড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশে এখনো সীমিতসংখ্যক হাসপাতালে আধুনিক ক্যাথ ল্যাব সেবা রয়েছে, তবে সময়মতো রোগী পৌঁছাতে পারলে জীবনরক্ষা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞ মতামত

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, হৃদরোগ এখন শুধু ধনী-শহুরে মানুষের রোগ নয়, গ্রামাঞ্চলেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। একবার হৃদরোগে আক্রান্ত হলে এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং আজীবনের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। অধিকাংশ রোগীকে নিয়মিত ওষুধ, পরীক্ষা এবং চিকিৎসকের ফলো-আপ চালিয়ে যেতে হয়, যা অনেক পরিবারের জন্য বড় অর্থনৈতিক চাপ।

তিনি আরও বলেন, তবে সুখবর হলো হৃদরোগের বড় অংশই প্রতিরোধযোগ্য। ধূমপান বর্জন, ওজন নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্যগ্রহণ, মানসিক চাপ এড়ানো এবং উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই সবচেয়ে কার্যকর ও সাশ্রয়ী উপায়। এজন্য পরিবার ও সমাজের প্রত্যেককে সচেতনতার আন্দোলনে যুক্ত হতে হবে।

আরও পড়ুন:

দেশে বাড়ছে কম বয়সী হার্টের রোগী৫৯ শতাংশ রোগীই জানেন না উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেনহাসলে কমে চাপ, ভালো থাকে হার্ট

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট ডা. মো. মেহেদী হাসান জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশে হৃদরোগের অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিত জীবনযাপন। কম বয়সী মানুষও এখন হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। জাঙ্ক ফুড, পর্যাপ্ত শারীরিক শ্রমের অভাব এবং দীর্ঘ সময় বসে কাজ করার প্রবণতা তরুণদের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।

তিনি আরও বলেন, যদি আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষকে সচেতন করতে পারি, যেমন স্কুল পর্যায়ে স্বাস্থ্যশিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং গণমাধ্যমে প্রচারণা, তাহলে আগামী প্রজন্মকে হৃদরোগের মতো মরণব্যাধি থেকে অনেকাংশে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ বিশেষজ্ঞ ডা. মারুফ রায়হান খান জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশীয় অঞ্চলের মানুষ সাধারণত ৫১-৫২ বছর বয়সে প্রথম হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে পড়ে, অথচ ইউরোপ-আমেরিকায় তা হয় গড়ে ৬৫ বছর বয়সে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এখন ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণরাও গুরুতর হার্ট অ্যাটাক নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এদের অনেকেরই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা কোলেস্টেরলজনিত সমস্যা নেই, তবুও ধূমপান তাদের বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য সচেতন জীবনযাপন অত্যন্ত জরুরি। প্রতিদিন অন্তত আধাঘণ্টা হাঁটা, অতিরিক্ত লবণ-চিনি এড়িয়ে চলা, মাংস ও দুধ পরিমিত মাত্রায় খাওয়া, এবং ডিম কুসুমসহ খাওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ধূমপান ত্যাগ করা। ধূমপান ছাড়ার দুই বছরের মধ্যেই হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। একইসঙ্গে বুকে তীব্র ব্যথা, ঘাম, বমি বমি ভাব বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে ইসিজি করানো উচিত, কারণ হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে সময়ই সবচেয়ে বড় বিষয়।

ডা. মারুফ রায়হান খান পরামর্শ দেন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও স্থূলতার যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া হৃদরোগ থেকে বাঁচা সম্ভব নয়। তাই প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

আজ ২৯ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব হার্ট দিবস। ১৯৯৯ সালে বিশ্ব হার্ট ফেডারেশন (ডব্লিউএইচএফ), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্ব হার্ট দিবসের ঘোষণা দেয়। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‌‍‍“ডন’ট মিস অ্যা বিট”। প্রতিবছর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি ঘিরে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে নানান কর্মসূচি পালন করা হয়।

এসইউজে/এসএনআর/জেআইএম