বিশ্ব হার্ট দিবস ২০২৫
হৃদরোগ : প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়
২৯ সেপ্টেম্বর সারা বিশ্বে পালিত হয় বর্তমানে বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৭০ ভাগের জন্য দায়ী অসংক্রামক ব্যাধি, ৮০ ভাগ মৃত্যু হয় তৃতীয় বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে কলেরা, ডায়রিয়া, বসন্ত, যক্ষ্মা, হামের মতো বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি সহজেই চিকিৎসায় নিরাময় হচ্ছে এবং প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপদ পানি, খাদ্য সরবরাহ, চিকিৎসা পদ্ধতি, কার্যকরী টিকা কর্মসূচি, সর্বোপরি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংক্রামক ব্যাধি কমছে এবং মানুষের গড় আয়ুও বেড়ে চলেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বয়সজনিত কারণে বার্ধক্যজনিত রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, অস্টিওপরোসিস, অস্টিওআর্থাইসিস, উচ্চ-রক্তচাপ, ক্যান্সার ও মানসিক রোগসহ অসংক্রামক রোগের প্রকোপ মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অসংক্রামক রোগের ১৭ ভাগ মৃত্যু হয় হৃদরোগে, যার মধ্যে শতকরা ৮২ ভাগ মৃত্যু হয় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের জনগণের। কারণ এর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। সাধারণ কিংবা মধ্যবিত্ত রোগীর পক্ষে এ ব্যয় বহন করা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না।
হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির রোগসমূহ : মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হার্ট বা হৃৎপিন্ড। হৃদরোগের ঝুঁকির ব্যাপারটি নির্ভর করে একজন মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করছে তার ওপর। অতিরিক্ত ধূমপান, শুয়ে-বসে সময় কাটানো, শরীর চর্চাহীন অলস জীবনযাপন ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণের কারণে চর্বি জমা হয়ে ধমনিগুলো সরু হতে থাকে। হৃৎপিন্ডের রক্তনালিতে রক্ত চলার পথ বা ধমনির ভিতর রক্ত প্রবেশের পথ আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে হৃৎপিন্ডকে অক্সিজেন দিতে ব্যর্থ হলেই ঘটতে পারে হার্ট অ্যাটাকের মতো জটিল রোগ।
হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালীর রোগসমূহের মধ্যে এনজাইনা পেকটোরিস, একিউট করোনারি সিনড্রোম, মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকশন, পেরিডাইটিস বা হৃৎপিণ্ডের আবরণে প্রদাহ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
হৃদরোগের রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকিসমূহ : বিভিন্ন কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যাকে বলা হয় রিস্ক ফ্যাক্টর বা সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য, আর কিছু অনিয়ন্ত্রণযোগ্য।
অনিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো হলো বয়স, লিঙ্গ ও বংশগত। নিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরের মধ্যে রয়েছে ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে কলেস্টারলের আধিক্য, ডায়াবেটিস, মুটিয়ে যাওয়া, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, চর্বিজাতীয় খাদ্য বেশি ও আঁশজাতীয় খাদ্য কম খাওয়া, মানসিক চাপ, মদপান, জন্মনিয়ন্ত্রক পিল খাওয়া ইত্যাদি।
কী করে বুঝবেন হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন কিনা? :
(১) মাঝে মাঝে বুকে সামান্য ব্যথা বা চাপ চাপ ভাব অনুভব করেন। বিশেষ করে পরিশ্রম বা হাঁটাচলা, সিঁড়িতে ওঠানামা করলে এমনকি খাওয়ার সময়ও বুকের ব্যথা বা চাপ অনুভূত হয়, আবার বিশ্রাম নিলে কমে যায়।
(২) হঠাৎ বুকের মাঝে খুব বেশি ব্যথা অনুভূত হওয়া, যা বাঁ-হাতের দিকে এমনকি গলা বা চোয়ালেও ছড়িয়ে যায়।
হঠাৎ কাশি বা তীব্রতর শ্বাসকষ্ট, অস্বস্তিবোধ, দুর্বলতা বা ক্লান্তিবোধ হওয়া।
(৩) বুকের ব্যথার সঙ্গে বমি বমি ভাব এমনকি বমি হওয়া, শরীরে অতিরিক্ত ঘাম, হঠাৎ মাথা ঘোরানো এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা এবং হৃদক্রিয়ার ছন্দ বেড়ে যাওয়া।
(৪) কোনোরকম ব্যথা ছাড়াও হঠাৎ শ্বাসকষ্ট অনুভূত হওয়া এবং বিছানায় চিত হয়ে শুতে গেলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া।
(৫) ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বুকে তীব্র ব্যথা অনুভূত নাও হতে পারে। তবে শরীর থেকে প্রচুর ঘাম ঝরা, মাথা ঘোরা ও ক্ষণিকের জন্য চেতনাহীন হয়ে পড়াটাই এই রোগীদের হার্ট অ্যাটাকের পূর্বলক্ষণ।
(৬) হঠাৎ করে পেটে ব্যথা বা গ্যাস হওয়া, বমি, বদহজম-জাতীয় লক্ষণ হতে পারে, যাকে অনেকেই সাধারণ গ্যাস্ট্রিক মনে করে অবহেলা করেন।
কী করবেন, যদি মনে হয় হার্ট অ্যাটাক হয়েছে :
ওপরের যে কোনো লক্ষণ অনুভূত হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত, বিশেষ করে যারা আগে থেকেই কোনো না কোনো হৃদরোগে ভুগছেন। এমনকি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অতিমাত্রায় কলেস্টারল রোগীদের বেলায়ও এসব লক্ষণ অনুভূত হলে অবহেলা করা উচিত নয়। জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
কীভাবে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব : সুস্থ, স্বাভাবিক ও আনন্দপূর্ণ জীবনের জন্য দরকার একটি সুস্থ হার্ট বা হৃদযন্ত্র। কিন্তু এ যন্ত্রটিকে সুস্থ রাখাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আধুনিক বিশ্বে জীবনযাত্রার নানামুখী পরিবর্তন, কাজের পরিবেশ সব কিছুই যেন প্রতিনিয়ত হার্টকে প্রতিকূলতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। তারপরও হার্টকে ভালো রাখতেই হবে। আর তাই সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের কোনো বিকল্প নেই। হৃদরোগের চিকিৎসা প্রায়ই ব্যয়বহুল। একবার আক্রান্ত হলে সারাজীবন এই মারাত্মক ব্যাধি পুষতে হয় এবং অনেক ওষুধ খেতে হয়। তাই এই রোগ প্রতিরোধ করাই উত্তম। নিরাময়যোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিলেই অনেক ক্ষেত্রে হৃদরোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
(১) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: ডায়াবেটিস রোগীদের অ্যাথারোস্কেলরোসিস বেশি হয়। ফলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। তাই রোগীদের অবশ্যই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
(২) উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: জীবন যাত্রায় পরিবর্তন এনে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিত। যত আগে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে, তত আগে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং জটিল রোগ বা প্রতিক্রিয়া হতে রক্ষা পাওয়া যায়।
(৩) ধূমপান বর্জন: হৃদযন্ত্রের অন্যতম প্রধান শত্রু ধূমপান। ধূমপায়ীদের শরীরে তামাকের নানা রকম বিষাক্ত পদার্থের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনী, শিরার নানা রকম রোগ ও হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়। ধূমপায়ীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। তামাক পাতা, জর্দা, গুল লাগানো ইত্যাদিও পরিহার করতে হবে।
(৪) অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা হ্রাস: যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে শরীরে ওজন বেড়ে যেতে পারে। এতে হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, ফলে অধিক ওজন সম্পন্ন লোকদের উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনী, শিরার নানা রকম রোগ ও হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
(৫) ওষুধ খেয়ে ওজন কমানো বিপজ্জনক: ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওজন কমানোর ওষুধ না খাওয়াই ভালো। স্থূলতায় হৃদরোগ থেকে শুরু করে নানা সমস্যা হতে পারে। ফলে ভারসাম্যপূর্ণ ও সঠিক ওজন বজায় রাখতে মনোযোগী হতে হবে। চর্বি জাতীয় খাবার এবং চিনি মিষ্টি কম খাওয়া ভালো।
(৬) নিয়মিত ব্যায়াম: হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখার জন্য ব্যায়ামের মতো কার্যকর অন্য কোনো পথ নেই। সকাল-সন্ধ্যা হাঁটা চলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হালকা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি। জিমে যেতে হবে এমন নয়। ঘরেই ব্যায়াম করা যায়। তাও না করতে পারলে প্রতিদিন অবশ্যই হাঁটতে হবে।
(৭) অতিরিক্ত লবণ নিয়ন্ত্রণ: খাবার লবণে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন বেড়ে যায় এবং রক্তচাপও বেড়ে যায়, ফলে হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে। অনেকেই খাবারের সঙ্গে কাঁচা লবণ খান। এটা অবশ্যই বর্জন করতে হবে। বেশি লবণ রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। এ থেকে হৃদযন্ত্রে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
(৮) চর্বিযুক্ত খাবার বর্জন: খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে বেশি আঁশযুক্ত খাবার, যেমন শাকসবজি, ফলমূল বেশি বেশি খাওয়া ভালো। রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টারল হলে রক্তনালীর দেয়াল মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। এর ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে এবং হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার ও কম কোলেস্টারল যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন খাশি বা গরুর গোসত, কলিজা, মগজ, গিলা, গুর্দা, কম খেতে হবে। কম তেলে রান্না করা খাবার এবং ননী তোলা দুধ, অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন সয়াবিন, ক্যানোলা, ভুট্টার তেল অথবা সূর্যমুখীর তেল খাওয়া যাবে।
(৯) মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে: অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ ও হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, শরীরকে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম দিতে হবে। নিজের শখের কাজ করা, নিজ ধর্মের চর্চা করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি বেশি হবে। অতিরিক্ত মানাসিক চাপ স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর। এজন্য খেলাধুলা, আড্ডা, বইপড়া, যোগব্যায়াম ও ধ্যান হতে পারে চাপ মুক্তির উত্তম দাওয়াই। প্রতি রাতে ভালো ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
(১০) মদ্যপান পরিহার: অতিরিক্ত মদ্যপান পরিহার করতে হবে। বেশি অ্যালকোহল গ্রহণ মানে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেওয়া। এতে হৃদস্পন্দনেও প্রভাব পড়ে। সুস্বাস্থ্য ও সবল হৃদযন্ত্রের জন্য ধূমপানের মতো মদ্যপানও ছাড়তে হবে।
হৃদরোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি চিকিৎসা সেবার বিস্তারেও নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তৃণমূল পর্যায়ে হৃদরোগের চিকিৎসা সহজলভ্য করে তুলতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশের চিকিৎসার খরচ প্রায় ৭০ শতাংশই রোগীকে বহন করতে হয়। তাই হৃদরোগের মতো ব্যয়বহুল রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে বহু মানুষকে প্রতি বছর দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যেতে হচ্ছে। অনেকে অর্থের অভাবে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। এই সমস্যার সমাধানে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা চালু করা জরুরি।
হৃদরোগ প্রতিরোধে সরকারের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়েও সচেতনতা বাড়াতে হবে। শিক্ষা ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। হৃদরোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের ব্যাপারে বেশি যতœবান হতে হবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। তবে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে যদি হৃদরোগের ঝুঁকিগুলো জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তাহলেই হৃদরোগ এবং এর ঝুঁকিপূর্ণ অকাল মৃত্যু এড়ানো সম্ভব। সুন্দর জীবনের জন্য সুস্থতা প্রয়োজন। সুস্থতার জন্য সুস্থ হার্টের বিকল্প নেই।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
এইচআর/জেআইএম