গ্রীক পুরাণে দেবরাজ জিউসের ক্ষমতায় আসার প্রথমদিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মানবজাতির সৃষ্টি। টাইটানদের সঙ্গে যুদ্ধ জয়ের পর জিউস সিদ্ধান্ত নেন প্রাণীকুল সৃষ্টি করবেন। এজন্য তিনি টাইটান গোত্রভুক্ত দেবতা প্রমিথিউস ও তার ভাই এপিমেথুসকে দায়িত্ব দেন। টাইটান যুদ্ধে জিউসকে সাহায্য করেছিলেন ইয়েপেতুস ও ওশেনিড ক্লাইমেনের ওরসজাত দুই ভাই। প্রমিথিউস ছিলেন বুদ্ধিমান। ভবিষ্যতে কি ঘটবে, আগেই বুঝতে পারতেন। কিন্তু এপিমেথুস আবেগপ্রবণ, তার ভাবনার বিষয় অতীতের ঘটনাবলী।মানুষ ও পশুপাখি সৃষ্টির জন্য দুই ভাইকে কিছু উপকরণ দেন জিউস- ধারালো নখ, দাঁত, খোলস, প্রখর দৃষ্টিশক্তি, ঘ্রাণশক্তি ইত্যাদি। এপিমেথুস এসব দিয়ে নানারকম প্রাণীকুল তৈরি করলেন। তারা সমুদ্র-বন-আকাশে বিচরণ করবে। এভাবে জিউসের দেয়া উপকরণগুলো দেখতে দেখতে শেষ করে ফেললেন এপিমেথুস। অন্যদিকে প্রমিথিউস ভাবনাক্লিস্ট মনে মানুষ তৈরিতে ব্যস্ত। প্রচন্ড আবেগ আর যত্নে এক দলা মাটি থেকে তিনি তৈরি করলেন মানুষ। তার হাত দিয়েই দেবতাদের আকৃতি পেলো মানুষ, অর্জন করলো সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ও আকাশের পানে মাথা উঁচু করে তাকানোর সামর্থ্য। প্রমিথিউসকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন জ্ঞানের দেবী এথেনা। মানুষ পেলো মানবীয় গুণাবলী; কিন্তু বিপত্তিটা আগেই তৈরি করে রেখেছেন অপরিণামদর্শী এপিমেথুস। জিউসের দেয়া সব উপকরণ তো আগেই শেষ! মানুষকে দেয়ার মতো অবশিষ্ট আর কিছুই নেই!পৃথীবিতে টিকে থাকতে পশুপাখীর থেকে দুর্বল হয়ে পড়লো মানুষ। এপিমেথুসের কল্যাণে শক্তিমত্তা, গতি, গরম খোলস ও পালক সহ আরো অনেক গুণাবলী পেয়েছিলো পশুপাখী। কিন্তু মানুষ ছিলো নগ্ন, দুর্বল এবং অনিরাপদ। প্রমিথিউস ভীষন কষ্ট পেলেন। নিজের সৃষ্টিকে আরো পরিণত ও নিরাপদ করতে তার ঘুম হারাম। প্রমিথিউস দেখলেন পৃথিবীতে মানুষ কতটা অসহায়, কতটা যন্ত্রনাক্লিষ্ট! আবেগ সংবরণ করতে পারলেন না তিনি। মানুষের হাতে প্রমিথিউস এমন এক জিনিষ তুলে দিতে চাইলেন, যা তার সৃষ্টিকে করে তুলবে দুর্দান্ত; বাকিদের থেকে অনন্যসাধারণ। সৃষ্টির সেরা!‘যদি তারা আগুন পেতো’- প্রমিথিউস ভাবলেন, ‘অন্ততপক্ষে তারা নিজেদের উঞ্চ রাখতে পারতো। খাবার সেদ্ধ করার পাশাপাশি আগুন দিয়ে তারা আরো কিছু জিনিষ তৈরি করতে পারতো নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য। আগুন ছাড়া তারা কিছুতেই বাঁচতে পারবে না।’দেবরাজ জিউসের কাছে ছুটে গেলেন প্রমিথিউস। চাইলেন আগুন। কিন্তু সেই সময় আগুন শুধুই স্বর্গের সম্পত্তি। দেব-দেবতাদের ব্যবহারের বস্তু। প্রমিথিউসের আবেদনকে জিউস শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, ক্ষেপে গেলেন তিনি, ‘এক স্ফুলিঙ্গ কণা আগুনও দেয়া যাবে না। মানুষকে আগুন দেয়া হলে সে শক্তিশালি হয়ে উঠবে। হয়ে উঠবে জ্ঞানী। কিছুদিন পর দেখা যাবে সে আমাদের অমান্য করছে। তারা যেমন আছে, তেমনই থাকতে দাও। সবসময়ের জন্য দরিদ্র আর অজ্ঞ থাকলে মানুষ আমাদের মান্য করবে।’প্রমিথিউস নিশ্চুপ। দেবরাজ দাবী নাকচ করে দিলে কি করতে হবে- এ সিদ্ধান্ত তার মনে মনে ঠিক করাই ছিলো। মানুষের প্রতি তার মমতার তখন কোন সীমা-পরিসীমা নেই। চিরদিনের মতো তিনি ছাড়লেন দেবরাজ জিউসের সঙ্গ।একদিন সুমদ্রের তীর ধরে হাঁটছিলেন প্রমিথিউস। হঠাৎ তার চোখে পড়লো একটি নলখাগড়া। মৌরি গাছের বৃন্তও বলে থাকে কিছু মিথ। প্রমিথিউস তা ভেঙ্গে দেখলেন, এর ভেতরটা সরু ও ফাঁপা। ভেতরকার শুকনো মজ্জা দেখে চকিত ভাবনা খেলে তার মাথায়- এটা তো অনেকক্ষণ জ্বলবে! দেরী না করে তিনি হাঁটা দিলেন সূর্যদেবতার বাসস্থানের উদ্দেশ্যে। খুব ভোরে যখন সূর্যদেব দিনের যাত্রা শুরু করবেন, তখন প্রমিথিউস পৌঁছালেন তার প্রাসাদে।সূর্যদেবের রথ থেকে এক স্ফুলিঙ্গ আগুন চুরি করে প্রমিথিউস তা ধারণ করলেন সেই নলখাগড়ায়। এ নিয়ে মতান্তর আছে। অনেকেই বলে থাকেন, আগুন চুরিতে দেবী হেরার সাহায্য নিয়েছিলেন প্রমিথিউস। সে যাই হোক, প্রমিথিউস পৃথীবিতে ফিরে এসে, আগুন তুলে দিলেন মানুষের হাতে। মানবসম্প্রদায় তা থেকে পেয়েছিলো জ্ঞান। গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী, প্রমিথিউস আগুন চুরি করে যেখানে রেখেছিলেন, সেখান থেকেই প্রাচীন অলিম্পিকের গোড়াপত্তন! অলিম্পিকে মশাল প্রজ্জ্বলনের রীতিটাও এসেছে মানুষের প্রতি প্রমিথিউসের মমত্ববোধকে স্বীকৃতি ও স্বীকার করে নিতে। মানুষের উপকারে তার ত্যাগ অবিষ্মরণীয়। প্রাচীন অলিম্পিকে জিউসের সম্মানে যে মশাল প্রজ্জ্বলন করা হতো, তার আলোকিত দিকটা আসলে মানুষের জন্য প্রমিথিউসের ত্যাগেরই স্বীকারোক্তি। মানুষের হাতে আগুন তুলে দেয়ার জন্য প্রমিথিউসকে সাইথিয়ার রুক্ষ পাথুরে পর্বতমালার সুউচ্চ শিখরে শৃংখলিত করে রেখেছিলেন জিউস। রোজ একটি ঈগল এসে প্রমিথিউসের কলিজা ঠুকরে খেতো, সেখানে জন্মানো নতুন আরো একটি কলিজা। পরদিন আবারো ঈগলটা এসে খেয়ে যেত প্রমিথিউসের কলিজা। মানুষকে উপকারের শাস্তিটা এভাবে পেয়েছিলেন প্রমিথিউস।সে যাই হোক, প্রাচীন অলিম্পিক যতটা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ধর্মীয় তাৎপর্য ছিলো তার থেকেও বেশি। অলিম্পিকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা জিউস ও হেরার মন্দিরে জ্বালিয়ে রাখা হতো মশাল। অর্থাৎ, আগুন। প্রাচীন অলিম্পিকে আগুনের তাৎপর্য বাকি সবকিছু ছাপিয়ে যেত। তখনো সূর্যের আলো থেকে জ্বালানো হতো মশাল। অলিম্পাস পাহাড়ে বিশেষ ধর্মীয় রীতি মেনে মশাল জ্বালাতেন ধর্মযাপিকারা। আধুনিক অলিম্পিকে সর্বপ্রথম মশাল প্রজ্জ্বলন রীতির শুরু ১৯২৮ আমস্টাডার্ম অলিম্পিকে, সেই প্রাচীন রীতি মেনে।সেই প্রাচীন কাল থেকে এখনো পর্যন্ত গ্রীসের অলিম্পিয়া পাহাড়ে ধর্মযাপিকার বেশে এগারোজন মহিলা সুর্যের আলো থেকে প্যারাবলিক আয়নার মাধ্যমে জ্বালান গর্বের মশাল। মাটিতে রাখা প্যারাবলিক আয়নায় সুর্যের আলো প্রতিফলিত করে সৃষ্টি করা হয় তাপ, সেখান থেকে আগুন। জ্বালানো হয় মশাল, সেই মশাল থেকে প্রজ্জ্বলিত হয় আরো একটি মশাল, যা তুলে দেয়া হয় একজন ক্রীড়াবিদের হাতে। সঙ্গে একটি জলপাই গাছের শাখা। ওড়ানো হয় শান্তির প্রতীক শ্বেত পায়রা। অলিম্পিকের এই আগুন মানুষের জীবন, যুক্তিবোধ, আবেগ আর স্বাধীনতার প্রতীক। মানুষ আর দেবতার মাঝে যে চিরকালিন যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির লড়াই- তার সেতুবন্ধনও এই আগুন, এই মশাল!মজার ব্যাপার হলো, মশালের ওজন ও দৈর্ঘ্য এক থাকলেও বদলেছে উপকরণ। ১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিকে ৪৭ মিটার লম্বা ও ৯৬০ গ্রাম ওজনের মশাল তৈরি করা হয় হিডুমিনিয়ামের দ্বারা। সেটা আসলে অ্যালুমিনিয়ামের সংকর ধাতু। ১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিকে হিডুমিনিয়ামের বদলে ব্যবহার করা হলো ম্যাগনেশিয়াম। পাল্টেছে মশালের শিখার তৈরির উপকরণও। কখনো জলপাই তেল, কখনো প্রপিলিনের তরল গ্যাস। মশালের আগুন যে কখনোই নেভে না, তা কিন্তু ঠিক নয়। এজন্য সংরক্ষণে রাখা হয় একই আগুনের একটি ছোট্ট লণ্ঠন। অলিম্পিকের উৎসভ‚মি গ্রীসের অলিম্পিয়া পাহাড়ের জায়গাটি একসময় আটমিটার মাটির তলে চাপা পড়ে গিয়েছিলো। ১৭৬৬ সালে ইংরেজ ইতিহাসবিদ রিচার্ড শ্যান্ডলার খুঁজে বের করেন অলিম্পিয়া। ১৮২৯ সালে প্রথম খননকাজ শুরুর পর একে একে উদঘাটিত হতে থাকে প্রাচীন অলিম্পিয়ার চমকপ্রদ সব ইতিহাস।১৯২৮ আর্মস্টাডার্ম অলিম্পিকে মশাল প্রজ্জ্বলনের রীতি পুর্নজীবিত করা হলেও ছিলো না মশাল দৌড়ের প্রথা। ১৯৩৬ বার্লিন অলিম্পিকে সর্বপ্রথম প্রচলন করা হয় মশাল দৌড়। অ্যাডলফ হিটলার তখন জার্মানির সর্বেসর্বা। বিশ্বকে নাৎসী ‘ব্লু-ব্লাড’-এর অভিজাত্য ও ক্ষমতার প্রদর্শনে তিনি নতুন কিছু করতে চেয়েছিলেন। এগিয়ে আসেন তার অন্যতম হাত জোসেফ গোয়েবলস। মশাল দৌড় তারই মস্তিষ্কপ্রসূত ধারণা। ভুল হলো। ধারণা নয়, প্রমিথিউসের সেই মিথকে তিনি নতুনভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন নিজের প্রপাগান্ডায়। সে গল্প হবে অন্য কোন দিন।জাগো চ্যাম্পিয়নের চতুর্থ সংখ্যা পুরোটা পড়তে ক্লিক করুণ এই লিংকে...আইএইচএস/পিআর