ফিচার

প্রবীণরা বোঝা নন, জ্ঞানের ভান্ডার

বয়স বাড়লে অনেকেই ভাবেন, মানুষের সক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। শরীরের শক্তি কমে আসে, হাঁটার গতি ধীর হয়, নানা অসুখ-বিসুখ ঘিরে ধরে। তরুণরা অনেকেই তখন মনে করেন প্রবীণরা কেবলই সংসারের বোঝা। অথচ বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।

বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে যে অভিজ্ঞতা, ধৈর্য, মমতা ও প্রজ্ঞার ভান্ডার তৈরি হয়, তা তরুণরা কখনোই একসঙ্গে অর্জন করতে পারেন না। তরুণরা হয়তো দ্রুত দৌড়াতে পারেন, প্রযুক্তির জগতে সাফল্য দেখাতে পারেন, কিন্তু প্রবীণদের কিছু বিশেষ কাজ ও গুণাবলি আছে যা চিরকালই তাদের কাছে অদ্বিতীয়। যেমন-

ধৈর্যের পাঠ জীবন মানেই উত্থান-পতনের গল্প। তরুণরা অস্থিরতায় অনেক সময় হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন, ভুলও করে ফেলেন। প্রবীণরা বছরের পর বছর ঝড়-ঝাপটা সামলে শিখেছেন ধৈর্য। তারা জানেন সময়ই বড় চিকিৎসক। কোনো সমস্যায় উত্তেজিত হয়ে নয়, শান্তভাবে সমাধান খুঁজে বের করাই সঠিক পথ। এ ধৈর্যের শিক্ষা তরুণদের জন্য অমূল্য।

পারিবারিক বন্ধন রক্ষাপরিবারে মতবিরোধ বা ঝগড়া হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তখন পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা সবাইকে বোঝান, শান্ত করেন, মিটমাট করেন। তাদের প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা পরিবারের বন্ধনকে অটুট রাখে। তরুণরা যতই চেষ্টা করুক না কেন, প্রবীণদের মতো সবার মন জয় করার ক্ষমতা সহজে পান না।

গল্প ও ইতিহাস শোনানো প্রবীণরা যেন হাঁটতে-ফিরতে চলমান ইতিহাস। তাদের কাছে আছে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, গ্রামীণ জীবনের গল্প, লোকসংস্কৃতির নানা স্মৃতি। শিশুরা কিংবা তরুণ প্রজন্ম এসব শুনে শুধু জ্ঞান অর্জনই করে না বরং নিজেদের শেকড়ের সঙ্গেও নতুন করে পরিচিত হন।

আদর ও স্নেহের ছোঁয়া দাদা-দাদি বা নানা-নানির মমতা শিশুদের মনে অদ্বিতীয় অনুভূতি জাগায়। তাদের কোলে মাথা রেখে গল্প শোনা, ভালোবাসার সঙ্গে খাওয়ানো এমন আবেগপূর্ণ মুহূর্ত তরুণ বাবা-মায়ের পক্ষেও অনুকরণ করা কঠিন। এই স্নেহ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পরিবারকে আরও দৃঢ় করে।

সরলভাবে বাঁচার শিক্ষাআজকের তরুণ সমাজ ভোগ-বিলাসে অভ্যস্ত। নতুন পোশাক, দামি খাবার, প্রযুক্তি সবই যেন জীবনের আবশ্যিক অংশ হয়ে গেছে। অথচ প্রবীণরা তাদের জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন, অল্পতেই সুখী হওয়া যায়। তারা শেখান কম খরচে, সহজভাবে বাঁচার কৌশল, যা জীবনকে শান্তিপূর্ণ করে তোলে।

প্রার্থনা ও বিশ্বাসে স্থিতিশীলতা ধর্মীয় অনুশীলন, আধ্যাত্মিকতা বা জীবনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এসব বিষয়ে প্রবীণদের অবস্থান তরুণদের চেয়ে গভীর। তাদের নিয়মিত প্রার্থনা বা ধ্যান শুধু তাদের মনকেই শান্ত রাখে না বরং পুরো পরিবারেও এক ধরনের প্রশান্তি আনে।

জ্ঞানের ভান্ডার প্রবীণদের কাছে আছে ঘরোয়া চিকিৎসা, দেশীয় কৃষি-কৌশল, লোকসংগীত, হস্তশিল্পের অগণিত জ্ঞান। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এসব জানেন না। বইপত্রেও এসব সহজে মেলে না। তাই প্রবীণদের কাছেই পাওয়া যায় ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির প্রকৃত শিক্ষা।

প্রবীণদের অসাধারণ গুণগুলোই স্মরণ করিয়ে দিতে প্রতি বছর ১ অক্টোবর পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’। জাতিসংঘ ঘোষিত দিনটির মূল উদ্দেশ্য হলো প্রবীণদের অবদানকে সম্মান জানানো, তাদের অধিকার রক্ষা করা এবং সমাজে তাদের মর্যাদা নিশ্চিত করা। প্রবীণরা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য পথপ্রদর্শক।

আমাদের উচিত প্রবীণদের মান্য করে চলা। তবুও আমাদের সমাজে অনেক প্রবীণই একাকিত্বে ভোগেন। সন্তানরা ব্যস্ততায় সময় দিতে পারেন না। কেউ কেউ আবার পুরোপুরি অবহেলিত থাকেন। অথচ তারা আমাদের অভিভাবক। তাদের ভালোবাসা, অভিজ্ঞতা ও দোয়া ছাড়া পরিবার পূর্ণতা পায় না।

তাদের সঙ্গে সময় কাটানো, সমস্যার কথা শোনা আমাদের কর্তব্য। পাশাপাশি সম্মানের সঙ্গে সম্বোধন করা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদেরই। প্রবীণরা সমাজের বোঝা নন, তারা একেকজন জ্ঞানের ভান্ডার। তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের সম্পদ। তাই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের উচিত তাদের সম্মান করা, পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের যেন কোনোভাবেই অবহেলিত না লাগে, তা নিশ্চিত করা।

শেষ পর্যন্ত এটাই সত্য, তরুণরা গড়ে তোলেন নতুন পৃথিবী আর প্রবীণরা শেখান সেই পৃথিবীতে টিকে থাকার প্রজ্ঞা। যে কাজগুলো প্রবীণরা পারেন, তরুণরা পারেন না; সেগুলোই আমাদের জন্য দিশারী। তাই প্রবীণদের সম্মান জানানো শুধু কর্তব্য নয়, আমাদের ভবিষ্যতের প্রতি বিনিয়োগও।

আরও পড়ুনআজ শুধু স্ত্রীর প্রশংসা করার দিন৩৪ বছর হাতের নখ কাটেন না তিনি

কেএসকে/এসইউ/জেআইএম