ফিচার

ঘোড়া চালানো শিখতে পারবেন ঢাকার ৩০০ ফিটে

আশরাফুল ইসলাম আকাশ

বিস্তীর্ণ জোড়া মাঠ, আর ফসলি জমি পেরিয়ে চোখের সামনে ধরা দিলো সাদামাটা এক অবকাঠামো। একপাশে টিনের চালের ঝুপড়ি ঘর। অন্যপাশে নরম মাটি আর ঘাস গজানো খোলা মাঠ। এর প্রবেশ দ্বারে শোভা পেয়েছে মহিষের মাথার খুলি আর কালো রঙের বাঁকানো ইয়ে বড় দুই শিং। গাছের গুড়ি দিয়ে তৈরি খুঁটির দুই পাশে রাখা গরুর গাড়ির চাকা। অলংকরণ বলতে এতটুকুই। বিশাল এই গেট পেরোতেই ছোটখাটো গড়নের এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। মাথায় কাউবয় হ্যাট, পায়ে কালো জুতা। দেখতে বেশ ফিটফাট। মুখোমুখি হতেই সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে পরিচয় দিলেন-আমি জাহেদুল ইসলাম। ঠোঁটের কোণে হাসিটা চওড়া করে বললেন, এই ‘হর্স রাইডিং ট্রেনিং সেন্টার’-এর প্রতিষ্ঠাতা আমি।

হর্স ট্রেনিং সেন্টার বা ঘোড়া চালানোর প্রশিক্ষণ সেন্টার বলতে যত জাঁকজমকপূর্ণ হওয়ার কথা তেমন কিছুই নয়। সেন্টারের চারপাশ বাঁশ দিয়ে ঘেরা। বড় আম গাছের ছায়ায় বিছানো হয়েছে কয়েকটা চেয়ার। এর পাশেই রাখা কাঠের টুল। এগুলোতে প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য কাউবয় হ্যাট, সেফটি হেলমেট শোভা পাচ্ছে। বাঁশ বেতের ওপর ঝুলছে ব্রাইডল, স্যাডল, রেইন। সওয়ার করার সময় ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে এসব বস্তু ব্যবহার করা হয়।

ঢাকার ৩০০ ফিটের রাস্তা থেকে নেমে পূর্বাচল ক্লাব পেরিয়ে কিছুদূর এগোলেই পাওয়া যাবে এই হর্স রাইডিং ট্রেনিং সেন্টার। দুপুরের রোদটা মাথার ওপর থেকে নেমে গেছে। বিকেল ৩টা থেকে শুরু হবে দিনের দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস। জাহেদুল জানালেন, সপ্তাহের ছয়দিন ট্রেনিং চলছে। রোববার সাপ্তাহিক ছুটি। আমাদের সেন্টারে ‘রেগুলার রাইডিং’ এবং ‘ইকুস্ট্রিয়ান’ প্রশিক্ষণ চালু আছে। নতুন করে সেই পালকে যুক্ত হয়েছে ‘শো জাম্পিং’ কোর্স।

প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য কাউবয় হ্যাট, সেফটি হেলমেট শোভা পাচ্ছে

জাহেদুলের হাতে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠানই দেশের প্রথম বেসরকারি হর্স রাইডিং ট্রেনিং সেন্টার। ভেবেছিলেন অশ্বারোহী হয়ে নিজেকে আত্মতৃপ্ত করবেন। যেমনটা চেয়েছিলেন, জেদের বসে করেছেনও তাই। নিজ প্রচেষ্টায় শিখেছেন ঘোড়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার গোপন কৌশল, নিয়ন্ত্রণ ও টগবগ করে ঘোড়াকে দাপিয়ে নিয়ে বেড়ানো। নিজের স্বপ্ন তো পূরণ হলো, এখন কর্মজীবনে ফেরার পালা। তবে হলো উল্টোটা। সবকিছু ছেড়ে ট্রেনিং সেন্টার খুলে বসলেন। সেটিও আবার হর্স রাইডিং। শুরুতে মানুষের কটু কথা শুনতে হলেও এখন শতশত তরুণ-তরুণীকে শেখাচ্ছেন ঘোড়ার পাঠ।

জাহেদুলের স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল ২০২১ সালে, জন্মস্থান চট্টগ্রামে। এরপর বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় ২০২৩ সালের জুলাইয়ে আসেন ঢাকায়। ১০০ ফিটে ছোট আয়োজনে শুরু করেন ট্রেনিং সেন্টার। সেখানে কয়েকমাস থেকে তার প্রতিষ্ঠানের নতুন ঠিকানা হয় পূর্বাচল। প্রশিক্ষণের জন্য এখন তার সেন্টারে মারওয়ারি জাতের চারটি ঘোড়া আছে। এই চার ঘোড়াতেই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে এই যুবকের।

বিকেল ৩টা পেরোতেই ট্রেনিং সেন্টারে শিক্ষার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকলো। জাহেদুলের নির্দেশনা পেতেই মাথায় হেলমেট লাগিয়ে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার করলেন আদিবা মাহমুদ। বেশ পেশাদার ভঙ্গিতে লাগাম টেনে মাঠে ঢুকলো। এরপর নানা অনুশীলনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মাঝে মাঝে ট্রেনিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে খোলা মাঠে ক্ষিপ্রগতিতে ঘোড়া নিয়ে ছুটছে। প্রথম দফার ২০ মিনিট অনুশীলন শেষ করে নেমে এলো এই কিশোরী। এই ফাঁকে ১২ বছর বয়সী লামিয়া জানালো, শুরুতে খুবই ভয় পেতাম। তবে এখন সেই ভয়টা কাজ করে না। ঘোড়ার সঙ্গে মানুষের একটা কানেকশন আছে। এ কারণে আমাদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া হয়েছে।

ঘোড়ার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার কৌশল,আচরণ ও ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণের জন্য থিউরিটিক্যাল ক্লাসও নেওয়া হয়

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এই প্রজন্মের শিশুরা ঘরকুনো স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে। সেই প্রথা ভাঙতেই কন্যা লামিয়াকে নিয়ে এই ট্রেনিং সেন্টারে হাজির হয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শাহানুর রহমান। তিনি জানালেন, অনুভূতি খুবই ভালো। এখন ওরা এআই, গ্যাজেটমুখী হয়ে পড়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে পরিবেশের সঙ্গে মিশে গিয়ে ঘোড়া চালানো শিখছে। অ্যাডভেঞ্চার শিখছে, ভালো লাগছে। জীবনে কঠিন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে পরিচিত করানোর চেষ্টা করছি। যেন আগামীতে ছোটখাটো বাধায় ভেঙে না পড়ে।

জাহেদুলের ট্রেনিং সেন্টারে আছে শতাধিকের বেশি শিক্ষার্থী। এদের কেউ চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী কিংবা শিক্ষার্থী। অবসর বের করে ইকুস্ট্রিয়ান কোর্স করছে সবাই। এ নিয়ে জাহেদুল জানালেন, কোর্সটা খুবই জনপ্রিয়। এক মাসে ৮টি ক্লাস। দিনে ৪০ মিনিট করে শেখানো হয়। নির্ধারিত এই সময়ের মধ্যে কারো প্রশিক্ষণ শেষ না হলে তাদের আরও সুযোগ দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি ঘোড়ার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার কৌশল, আচরণ ও ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণের জন্য থিউরিটিক্যাল ক্লাসও নিচ্ছেন তিনি।

নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি ঘোড়ার পরিচর্যা ও পরিপাটির জন্য ৩ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন জাহেদুল। যাদের কাজই হলো খ্যাপাটে ঘোড়াদের আদর যত্নে লালন করা। সবকিছু ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মতো সার্বক্ষনিক পর্যবেক্ষণ করছে কালো রঙের জার্মান শেফার্ড। একটু এদিক-সেদিক হলেই লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে বসছে সে।

জাহেদুলের ট্রেনিং সেন্টারে আছে শতাধিকের বেশি শিক্ষার্থী

জাহেদুলের ট্রেনিং সেন্টারের জ্ঞান নিয়ে ইউরোপে উড়াল দিচ্ছেন বিদেশগামী তরুণরা। ঘোড়ার আদ্যপ্রান্ত শিখে বিদেশের মাটিতে ইউরো উপার্জন করছেন। এখন তার ট্রেনিং সেন্টারে ইনহাউজ প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন দুজন। তাদের একজন জানালেন, ইউরোপের একটি দেশের ভিসা আমার হাতে পৌঁছেছে। সেখানে গিয়ে জকি হিসেবে কাজ করতে হবে। এজন্য দেশের মাটিতেই নিজেকে প্রস্তুত করছি। যেন সেখানে কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়।

নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়ে জাহেদুল বললেন, ‘সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় আর্থিক অনুদান পেলে এই প্রতিষ্ঠানকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চাই। তৈরি করতে চাই আন্তর্জাতিক মানের ঘোড়দৌড় প্রতিযোগী। দেশের পতাকা নিয়ে যারা অলিম্পিকের মতো মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করবে। তবে সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে উন্নত জাতের ঘোড়া আনতে পারছি না। সরকার সহযোগিতা করলে বৃহৎ আকারে আমাদের কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।’

আরও পড়ুনপ্রবীণরা বোঝা নন, জ্ঞানের ভান্ডার৩৪ বছর হাতের নখ কাটেন না তিনি

কেএসকে/এএসএম