লাইফস্টাইল

সিরিয়াস মুহূর্তে হঠাৎ হাসি আসে কেন?

আমাদের জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন হাসি একেবারেই মানায় না। অথচ তখনই মুখে ফুটে ওঠে একরাশ হাসি। হয়তো ক্লাসে শিক্ষক রাগে গর্জাচ্ছেন, চারপাশে নীরবতা, অথচ বন্ধু সামান্য ভঙ্গি করে ফেলতেই আপনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না। আবার দেখা গেল, শোকসভায় সবাই দুঃখে কাতর হলেও হঠাৎ মুখে হঠাৎ হাসি চলে এলো। এই অপ্রত্যাশিত এবং অপ্রাসঙ্গিক হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে জটিল মনস্তাত্ত্বিক, স্নায়বিক এবং সামাজিক ব্যাখ্যা।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় 'অপ্রাসঙ্গিক হাসি' আর কেউ বলে 'নার্ভাস লাফটার'। অর্থাৎ এমন হাসি, যা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খায় না। এই ধরনের হাসি অনেক সময় বিব্রতকর হয়। কারণ আশেপাশের মানুষ মনে করতে পারে আপনি পরিস্থিতিকে হালকাভাবে নিচ্ছেন। অথচ বাস্তবে হাসি তখন অবচেতনভাবে মনের গভীর চাপ বা উত্তেজনা সামলানোর উপায় হিসেবে বেরিয়ে আসে।

মানুষের মস্তিষ্ক সবসময় আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। যখন কেউ ভয়, দুঃখ বা উদ্বেগে আচ্ছন্ন হয়, তখন মস্তিষ্ক সেই আবেগের তীব্রতা কমানোর জন্য বিকল্প প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। গবেষকরা মনে করেন, হাসি সেই বিকল্প প্রতিক্রিয়ার একটি মাধ্যম। এক অর্থে, হাসি আমাদের অভ্যন্তরীণ আবেগকে হালকা করে দেয়। তাই গম্ভীর মুহূর্তে হঠাৎ হাসি আসা মানে ভেতরের চাপকে সামলাতে শরীর নিজের মতো করে একটি প্রতিকার খুঁজে নিয়েছে।

অপ্রত্যাশিত হাসির পেছনে শারীরিক বা স্নায়বিক কারণও থাকতে পারে। বলতে পারেন সিউডোবালবার অ্যাফেক্ট। এই অ্যাফেক্টে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কান্না বা হাসি চলে আসে। আবার 'জেলস্টিক ' নামের এক ধরনের মৃগীরোগে কোনো আনন্দ ছাড়াই হঠাৎ উচ্চহাসি শুরু হতে পারে। এসব ক্ষেত্রেই হাসি আনন্দের নয়, বরং দুশ্চিন্তার কারণ। সাথে স্নায়বিক বিকৃতির ফল। অর্থাৎ, হাসি সব সময় মনের আনন্দের প্রকাশ নয়, কখনো এটি রোগের লক্ষণও হতে পারে।

মনোবিজ্ঞানের আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, হাসি এক ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যখন আমরা চাপ বা ভয় অনুভব করি, তখন অবচেতনভাবে হাসির মাধ্যমে সেটিকে হালকা করার চেষ্টা করি। এতে আমাদের ভেতরে একটি সংকেত তৈরি হয়। সংকেতটি আমাদের বলতে চায় 'ঘটনাটি ততটা ভয়ঙ্কর নয়।' এভাবেই কঠিন পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় মনে হয়। এজন্য অনেক সময় মানুষ শোকের সংবাদ শুনেও হেসে ফেলতে পারে! যদিও ভেতরে ভেতরে সে কষ্ট পাচ্ছে।

হাসি সামাজিক আচরণেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনেক সময় কঠিন আলোচনার সময় বা সংকটের মুহূর্তে হাসি আসলে অন্যদের প্রতি একটি বার্তা দেয় যে, 'আমি চেষ্টা করছি সামলে নিতে।' এটি এক ধরনের সংকেত, যা সম্পর্কের টানাপোড়েন কমিয়ে সামাজিক পরিবেশকে কিছুটা নরম করে। উদাহরণস্বরূপ, শোকসভায় কারও হঠাৎ হাসি দেখা গেলে অন্যরা প্রথমে অবাক হয়, কিন্তু এর ভেতরে আসলে চাপ সামলানোর চেষ্টা থাকে।

তবে এ সম্পর্কে আরেকটি তত্ত্ব রয়েছে। সেটি অসামঞ্জস্য তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, যখন প্রত্যাশা আর বাস্তবের মধ্যে অসামঞ্জস্য তৈরি হয়, তখন তা হাসির জন্ম দেয়। গম্ভীর পরিবেশে হঠাৎ হাসি মানে পরিবেশের সঙ্গে অনুভূতির মধ্যে এক ধরনের বৈপরীত্য তৈরি হয়েছে, আর সেটিই হাসিকে উস্কে দেয়।

এখন প্রশ্ন হলো বাস্তবে এটি কেমন দেখা যায়? উদাহরণস্বরূপ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক গম্ভীরভাবে পড়াচ্ছেন, হঠাৎ সহপাঠী কলম ফেলে দিয়ে বানরের মতো মুখভঙ্গি করল। পুরো ক্লাস গম্ভীর হয়ে আছে। অথচ কেউ কেউ হাসি আটকে রাখতে পারল না। আবার ধরা যাক, হাসপাতালে রোগীর অবস্থা সংকটজনক, আত্মীয়স্বজন কান্নায় ভেঙে পড়েছেন কিন্তু একজন আত্মীয় হঠাৎ হেসে ফেললেন। আসলে তিনি চাপ সহ্য করতে না পেরে অবচেতনভাবে হাসিকে আশ্রয় নিয়েছেন!

তবে এই হাসি যদি ঘন ঘন ঘটে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং সামাজিকভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে, তবে এটিকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। কারণ এটি স্নায়বিক বা মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে। চিকিৎসাবিদরা বলেন, যদি অকারণে প্রায়ই গম্ভীর মুহূর্তে হাসি চলে আসে, তবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

আজকে বিশ্ব হাসি দিবস। প্রতি বছরের অক্টোবরের প্রথম শুক্রবার পালিত হয় দিবসটি। তাই আজ হাসুন মন খুলে। বলা যায়, সিরিয়াস মুহূর্তে হঠাৎ হাসি আসা মানুষের স্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের অংশ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি এক ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যা মূলত চাপ ও তীব্র আবেগকে সাময়িকভাবে কম করে। তবে অস্বাভাবিক মাত্রায় ঘটলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কেননা এই হাসি আপনার বিপদের কারণ হতে পারে।

সূত্র: মায়ো ক্লিনিক, পাবমেড, হোয়াই ডট অর্গ, মেডিকেল নিউজ টুডে

আরও পড়ুনঅতিরিক্ত রাগ কীসের লক্ষণ পেশি না হারিয়ে ওজন কমানোর উপায় 

এসএকেওয়াই/জিকেএস