ফিচার

চিড়িয়াখানায় প্রাণীর কষ্টে আমরা কবে সচেতন হবো?

ছোট্ট রিশান হাত ধরে বাবার সঙ্গে ঢুকেছে চিড়িয়াখানায়। কৌতূহলী চোখে চারপাশ দেখছে সে। খাঁচার ভেতর এক কোণে বসে আছে এক বানর। চুপচাপ, একেবারে নীরব। রিশান বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন তরুণ পাথর কুড়িয়ে বানরের দিকে ছুড়ে মারে। কেউ আবার পানির বোতল ছুড়ে দিয়ে হেসে ওঠে। ভয় পেয়ে বানরটা আচমকা লাফিয়ে খাঁচার কোণে চলে যায়। রিশান বিভ্রান্ত হয়ে বাবার দিকে তাকায় ‘ওরা কেন এমন করছে?’

এমন দৃশ্য আসলে আমাদের অনেকের চোখেই ধরা দেয়। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ সময়ই চুপ থাকি। যেন খাঁচার ভেতর থাকা প্রাণীর অনুভূতির কোনো মূল্যই নেই। অথচ এই প্রাণীরাও ভয় পায়, কষ্ট পায়, বিরক্ত হয়।

রাজধানীর মিরপুর চিড়িয়াখানায় প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী আসে। অনেকে পরিবার নিয়ে, কেউ স্কুলের দল বেঁধে, কেউ বা বন্ধুদের সঙ্গে। প্রাণী দেখার এই আনন্দঘন মুহূর্তেই অনেক সময় দেখা যায় দর্শনার্থীরা খাঁচায় ঢিল ছোড়ে, ফল বা খাবার ছুড়ে মারে, গালাগাল দেয় কিংবা খাঁচায় লাঠি বা বোতল ঠুকে প্রাণীদের ভয় দেখায়।

এতে প্রাণীরা ভয় পেয়ে যায়, অস্বাভাবিক আচরণ করে, অনেক সময় আঘাতও পায়। কিছু প্রাণী আতঙ্কে খাবার খাওয়া বন্ধ করে ফেলে, এমনকি অসুস্থ হয়ে পড়ে।

চিড়িয়াখানার সূত্রে জানা যায়, দর্শনার্থীদের অসচেতন আচরণে অনেক সময় প্রাণীরা ভয় পেয়ে যায় বা আহত হয়। বিশেষ করে বাঘ, সিংহ, বানরের দিকে ঢিল ছোড়ার প্রবণতা বেশি। এছাড়া বিরক্ত করাতো আছেই। ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা, জনসম্মুখে প্রাণীকে কটুক্তি করে কথা বলার ঘটনা বেশি। এতে প্রাণীগুলোর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়।

আমরা প্রায়ই ভুলে যাই প্রাণীরাও অনুভব করতে পারে। খাঁচায় থাকা প্রাণীরা মানুষের এই আচরণে ভয় পায়, তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়।

চিড়িয়াখানাকে কেন্দ্র করে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, দর্শনার্থীদের আচরণ প্রাণীদের মানসিক অবস্থায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ জার্নাল অব ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স প্রকাশিত ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, ‘দর্শনার্থীর সংখ্যা ও তাদের আওয়াজ যত বাড়ে, খাঁচায় থাকা অনেক প্রাণীর মধ্যে অস্থিরতা ও ভয় পাওয়ার আচরণ ততটাই স্পষ্ট হয়। বিশেষ করে বানর ও হরিণ প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে অস্বাভাবিক ঘোরাঘুরি, এক জায়গায় গুটিয়ে বসে থাকা কিংবা শব্দে আতঙ্কিত হয়ে লাফিয়ে ওঠার মতো লক্ষণ দেখা গেছে, যা মানসিক চাপের ইঙ্গিত দেয়।’

বাংলাদেশে প্রাণী কল্যাণ আইন ২০১৯ অনুযায়ী প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ দণ্ডনীয় অপরাধ। চিড়িয়াখানায় প্রাণীকে আঘাত করা, উত্যক্ত করা বা ভয় দেখানো আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে দর্শনার্থীদের এ ধরনের আচরণে খুব কম ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।প্রবেশদ্বারে কিছু সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড ঝুললেও দর্শনার্থীদের বড় অংশই সেগুলো উপেক্ষা করে।

চিড়িয়াখানা কেবল বিনোদনের স্থান নয়, এটি শিক্ষামূলক ও সংরক্ষণমূলক জায়গা। এখানে প্রাণীদের প্রাকৃতিক পরিবেশ যতটা সম্ভব ধরে রাখা হয়, যাতে মানুষ কাছ থেকে তাদের সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু দর্শনার্থীদের দায়িত্বহীন আচরণ এই উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করে।

সমাজের সচেতন মহলের মতে, চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের প্রতি আচরণে সচেতনতা তৈরি করতে হলে দর্শনার্থীদের জন্য আলাদা দিকনির্দেশনা ও কঠোর তদারকি প্রয়োজন। শিশুদের ছোটবেলা থেকেই প্রাণীদের প্রতি সহমর্মিতা শেখানো দরকার।

আজ ৪ অক্টোবর, বিশ্ব প্রাণী দিবস। বিশ্বের নানা প্রান্তে আজ প্রাণীর অধিকার ও কল্যাণ নিয়ে নানা কর্মসূচি হচ্ছে। এই দিনে আমাদেরও ভাবা উচিত আমরা দর্শনার্থী হিসেবে কতটা দায়িত্বশীল! খাঁচার ভেতরে থাকা সেই বানরটি তো কথা বলতে পারে না, প্রতিবাদ করতে পারে না। কিন্তু আমরা পারি। দর্শনার্থী হিসেবে প্রাণীদের বিরক্ত না করা, কাউকে করতে দেখলে প্রতিবাদ করা আমাদের দায়িত্ব‌। আমাদের এই সামান্য উদ্যোগেই হতে পারে বড় পরিবর্তনের শুরু।

চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ শুধু তাদের কষ্টই বাড়ায় না, আমাদের সমাজের মানবতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। প্রাণীকে ভালোবাসা মানে কেবল পোষা কুকুর বা বিড়ালকে আদর করা নয়, বরং প্রতিটি প্রাণীর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। আজ প্রাণী দিবসে প্রতিজ্ঞা হোক, খাঁচার ভেতরের চোখের দিকে তাকিয়ে আমরা আর কোনো ঢিল ছুড়ব না। আরও পড়ুনপ্রবীণরা বোঝা নন, জ্ঞানের ভান্ডার৩৪ বছর হাতের নখ কাটেন না তিনি

কেএসকে/এএসএম