জাগো জবস

বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বিশ্বজয়ের চাবিকাঠি কী?

বাংলাদেশ উত্থানশীল অর্থনৈতিক শক্তিরূপে বিশ্বদরবারে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করছে। এর কেন্দ্রে রয়েছে একদল সাহসী, সৃজনশীল ও অদম্য তরুণ-তরুণী। যারা দেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে দিচ্ছেন তাদের স্টার্টআপ ও উদ্যোগের মাধ্যমে। স্থানীয় সমস্যার স্থানীয় সমাধান থেকে শুরু করে বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশের লক্ষ্য—সবখানেই তাদের পদচারণা সগর্ব। কিন্তু এই যাত্রাপথে, বিশেষ করে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা এবং সাফল্যের শিখরে পৌঁছানোর জন্য একটি দক্ষতা তাদের অস্ত্রাগারে থাকা অপরিহার্য, আর তা হলো ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের অস্তিত্বের ভাষা, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও সংযোগের ভাষা হিসেবে ইংরেজির ভূমিকা অসামান্য।

বৈশ্বিক বাজারের প্রবেশদ্বারএকবিংশ শতাব্দীর বাজার হচ্ছে সীমানাহীন। একজন বাংলাদেশি উদ্যোক্তার পণ্য বা সেবা কেবল ঢাকা, চট্টগ্রাম বা খুলনায়ই সীমাবদ্ধ নেই। এর গ্রাহক হতে পারে নিউইয়র্ক, বার্লিন, সিঙ্গাপুর বা সাও পাওলোর কেউ। এই বৈশ্বিক গ্রামে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ইংরেজি।

১. আন্তর্জাতিক গ্রাহক ও ক্লায়েন্ট অর্জন: একটি ওয়েবসাইট, একটি মোবাইল অ্যাপ বা একটি সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন—যে কোনো প্ল্যাটফর্মে বৈশ্বিক উপস্থিতির মূল ভিত্তি ইংরেজি। ইংরেজিতে কার্যকরীভাবে নিজের ব্র্যান্ডের গল্প বলতে পারলে, পণ্যের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে পারলে এবং কাস্টমার সার্ভিস দিতে পারলেই কেবল আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব।

২. বিনিয়োগ আকর্ষণ: বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম দিন দিন বড় হচ্ছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ও ভেঞ্চার ক্যাপিটালের (ভিসি) জন্য এটি একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হচ্ছে। একজন বিদেশি বিনিয়োগকারীর কাছে ব্যবসায়িক প্রস্তাব উপস্থাপন, ফাইন্যান্সিয়াল প্রজেকশন ব্যাখ্যা করা এবং কোম্পানির ভিশন-মিশন বোঝানোর একমাত্র কার্যকর ভাষা ইংরেজি। দুর্বল ইংরেজি দক্ষতা বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিতে পারে। কারণ এটি পেশাদারত্বের অভাব এবং যোগাযোগের ঝুঁকি হিসেবে প্রতিভাত হয়।

৩. বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে একীভূতকরণ: উদ্যোগ শুধু পণ্য রপ্তানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অনেক সময় উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল বা প্রযুক্তি আমদানিরও প্রয়োজন হয়। আন্তর্জাতিক সাপ্লায়ার, ম্যানুফ্যাকচারার এবং লজিস্টিক পার্টনাদের সাথে চুক্তি আলোচনা ও কার্যকর সমন্বয়ের জন্য ইংরেজি অপরিহার্য।

জ্ঞান ও তথ্যের ভান্ডার উন্মোচনইংরেজি হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির রাজভাষা। ইন্টারনেটে বিদ্যমান সমস্ত তথ্যের ৬০% এরও বেশি ইংরেজি ভাষায় লিখিত।

১. বিশ্বমানের শিক্ষা ও গবেষণা: একজন উদ্যোক্তাকে তার ক্ষেত্র সম্পর্কে সর্বশেষ ট্রেন্ড, মার্কেট রিসার্চ, কেস স্টাডি এবং একাডেমিক গবেষণা সম্পর্কে জানতে হয়। এ সমস্ত তথ্যের সবচেয়ে বড় এবং আপ-টু-ডেট উৎস—যেমন হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ, বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন কোর্স এবং ইন্ডাস্ট্রি-স্পেসিফিক জার্নাল—সবই ইংরেজিতে উপলব্ধ। ইংরেজি না জানার অর্থ হলো জ্ঞানের এই বিশাল সমুদ্র থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।

২. ব্যবসায়িক সরঞ্জাম ও রিসোর্স: আধুনিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার, অ্যানালিটিক্স টুলস, ডিজিটাল মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম (গুগল অ্যাডস, মেটা ফর বিজনেস) এবং ক্লাউড সার্ভিসের ইন্টারফেস ও সাপোর্ট সিস্টেম প্রধানত ইংরেজিভিত্তিক। এগুলো দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে ইংরেজি জ্ঞান প্রয়োজন।

৩. নেতৃত্বের বিকাশ: বিশ্বের সফলতম উদ্যোক্তা ও শিল্পপতিদের আত্মজীবনী, বক্তৃতা এবং ইন্টারভিউ মূলত ইংরেজিতে আছে। তাদের চিন্তা-ভাবনা, সাফল্যের গল্প এবং ব্যর্থতার শিক্ষা সরাসরি বুঝতে পারা একজন উদীয়মান উদ্যোক্তার জন্য অমূল্য প্রেরণা ও দিকনির্দেশনা হয়ে উঠতে পারে।

প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে প্রবেশাধিকারবাংলাদেশের ডিজিটাল বিপ্লব এবং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ভিশনের কেন্দ্রে রয়েছে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন। আর খাতটি পুরোপুরিভাবে ইংরেজির ওপর নির্ভরশীল।

১. প্রোগ্রামিং ও টেক স্টার্টআপ: সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, এআই, মেশির লার্নিং, ব্লকচেইন—প্রযুক্তির এই মৌলিক ভাষাগুলোর সিনট্যাক্স এবং ডকুমেন্টেশন ইংরেজিতে। একজন টেক উদ্যোক্তা হিসেবে বিশ্বমানের প্রোডাক্ট ডেভেলপ করতে, আন্তর্জাতিক ডেভেলপারদের সাথে কাজ করতে এবং গ্লোবাল টেক কমিউনিটির সাথে যুক্ত থাকতে ইংরেজি জানা বাধ্যতামূলক।

২. আইনগত ও নিয়ন্ত্রক জ্ঞান: আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস (পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক), ডেটা প্রাইভেসি নীতিমালা (যেমন জিডিপিআর) সম্পর্কিত সমস্ত জটিল আইন ও শর্তাবলি ইংরেজিতে প্রণীত এবং আলোচিত হয়। এগুলো বোঝা এবং মেনে চলা ব্যবসাকে বিশাল ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে।

নেটওয়ার্কিং ও সহযোগিতার সেতুবন্ধব্যবসার বিশ্বে বলা হয়, ‘ইওর নেটওয়ার্ক ইজ ইওর নেট ওর্থ’। অর্থাৎ আপনার নেটওয়ার্কই আপনার মূলধন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার এককভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম ইংরেজি।

১. আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও মেলায় অংশগ্রহণ: বিশ্বব্যাপী আয়োজিত বিভিন্ন স্টার্টআপ সামিট, ট্রেড শো এবং ইনভেস্টর মিটে অংশ নিয়ে মূল্যবান কন্টাক্ট তৈরি করা যায়। এসব ইভেন্টে কার্যকরভাবে কথোপকথন চালানো, আইডিয়া শেয়ার করা এবং সম্ভাব্য পার্টনার খুঁজে পাওয়া ইংরেজির দক্ষতার ওপরই নির্ভর করে।

আরও পড়ুনবিদেশে উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ারে যেসব দক্ষতা জরুরিঅনিকা তাহসিনের মাইক্রোসফট জয়

২. গ্লোবাল পার্টনারশিপ: অনেক সময় ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য বিদেশি কোম্পানির সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার বা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ প্রয়োজন হয়। এ ধরনের জটিল আলোচনা এবং চুক্তি প্রস্তুতিতে ইংরেজিতে পারদর্শিতা চাবিকাঠির ভূমিকা পালন করে।

৩. অনলাইন কমিউনিটি: লিংকডইন, এক্স এবং বিভিন্ন বিশেষায়িত ফোরামে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে সরাসরি সংযুক্ত হওয়া যায়। তাদের পোস্ট, আর্টিকেল এবং আলোচনায় অংশ নিয়ে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলা এবং জ্ঞান অর্জন করা ইংরেজির মাধ্যমেই সম্ভব।

ব্র্যান্ডিং ও বিপণনের আন্তর্জাতিকীকরণএকটি স্থানীয় ব্র্যান্ডকে গ্লোবাল ব্র্যান্ডে রূপান্তরের জন্য ইংরেজিতে দক্ষ মার্কেটিং অপরিহার্য।

১. কনটেন্ট মার্কেটিং: ব্লগ, শ্বেতপত্র, কেস স্টাডিজের মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেকে একজন থট লিডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ইংরেজিতে উচ্চমানের কনটেন্ট তৈরি করতে হয়।

২. সোশ্যাল মিডিয়া পরিচালনা: ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্সের মতো প্ল্যাটফর্মে বৈশ্বিক অডিয়েন্সের সাথে এনগেজমেন্ট বাড়ানোর জন্য ইংরেজি কনটেন্ট গুরুত্বপূর্ণ।

৩. পাবলিক রিলেশনস: আন্তর্জাতিক মিডিয়া আউটলেট যেমন- ফোর্বস, টেকক্রাঞ্চ, ব্লুমবার্গ-এ ফিচার হওয়া একটি স্টার্টআপের জন্য বিশাল সাফল্য বয়ে আনে। এ মিডিয়াগুলোর সাথে যোগাযোগ এবং তাদের জন্য প্রেস রিলিজ প্রেরণ করতে হয় ইংরেজিতেই।

চ্যালেঞ্জ ও করণীয়বাংলাদেশের অনেক উদ্যোক্তা, বিশেষ করে যারা নন-আরবান বা সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে এসেছেন; তাদের জন্য ইংরেজি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থেকে যায়। এখানে কিছু সমাধান উপায় রয়েছে:

১. মনোভাবের পরিবর্তন: ইংরেজিকে একটি বিলাসিতা বা শুধু পরীক্ষার বিষয় না ভেবে এটিকে একটি ক্যারিয়ার-এনহ্যান্সমেন্ট স্কিল হিসেবে দেখা উচিত।

২. বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা: ইংরেজি শিক্ষার ফোকাস হওয়া উচিত গ্রামার-কেন্দ্রিক না হয়ে কমিউনিকেশন-কেন্দ্রিক। ব্যবসায়িক ইংরেজি, ই-মেইল রাইটিং, প্রেজেন্টেশন স্কিল এবং নেগোশিয়েশন স্কিলের ওপর জোর দিতে হবে।

৩. প্রযুক্তির ব্যবহার: আইইএলটিএস অন কম্পিউটার, টোফেল আইবিটি, পিটিই, ডুয়োলিংগো, বিবিসি লার্নিং ইংলিশ, ইউটিউব-চ্যানেল এবং অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে বাড়িতে বসেই ইংরেজির দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব।

৪. কর্পোরেট ও সরকারি উদ্যোগ: বেসরকারি সংস্থাগুলো তাদের উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। সরকারি পর্যায়ে আইসিটি ডিভিশন, স্টার্টআপ বাংলাদেশের মতো সংস্থাগুলো উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রোগ্রামের মধ্যে ইংরেজি ভাষার প্রশিক্ষণকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা এবং ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে উদ্যোক্তারাই হচ্ছেন মূল চালিকাশক্তি। তাদের এ যাত্রাকে ত্বরান্বিত করে বিশ্বমঞ্চে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ইংরেজি ভাষা শক্তিশালী অনুঘটক। এটি কেবল ভাষাই নয়, একটি গ্লোবাল পাসপোর্ট, জ্ঞানের চাবিকাঠি এবং সাফল্যের কৌশলগত হাতিয়ার। বাংলার সাথে ইংরেজির সমন্বয় বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের স্থানীয় পরিচয়ে বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠার ক্ষমতা দেবে।

তাই সময় এসেছে প্রতিটি উদীয়মান এবং প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তার জন্য ইংরেজি দক্ষতাকে তাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গড়ে তোলার। কারণ আজকের এ আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে যিনি ভাষা বুঝতে ও বলতে পারেন; তিনিই নেতৃত্ব দিতে পারেন।

এসইউ/জেআইএম