সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন নানা শ্রেণিপেশার সংস্কৃতিপ্রেমীরা। তবে অনুষ্ঠান শুরুর আগে এখানে ‘নাচ-গান’ হবে এমন খবর পেয়ে একদল উত্তেজিন জনতা সেখানে এসে আপত্তি জানায়। পরে কথা বলার মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়।
বুধবার (৮ অক্টোবর) সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী লালবাগ কেল্লায় সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক রেজাউদ্দিন স্টালিন জানান, ‘এখানে নাচ-গান হবে শুনে একদল লোক এসে বাধা দিতে চেয়েছিল। পরে আমরা তাদের বুঝিয়ে বলি, এটি নাচ–গানের অনুষ্ঠান নয় বরং ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জন্মবার্ষিকী উদযাপন। এরপর তারা শান্ত হয়ে চলে যান।’
একই তথ্য জানিয়েছেন পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী। তিনি গণমাধ্যমে বলেন, ‘পুরো ঘটনাটি ছিল ভুল বোঝাবুঝি। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলার পর তারা স্থান ত্যাগ করেন।’
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সংগীত পরিবেশনা ও স্মৃতিচারণার মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো হয় কিংবদন্তি সুরসাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এ আয়োজনের বিশেষ আকর্ষণ ছিল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রপৌত্র সিরাজ আলী খানের সরোদবাদন পরিবেশনা। অনুষ্ঠানে সিরাজ আলী খানকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠান উপলক্ষে ভারত থেকে এসেছেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের একটি ভিডিও বার্তার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। তিনি বলেন, ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ শাস্ত্রীয় সংগীতকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করেছিলেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনদের নিয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা আরও সমৃদ্ধ হতে পারব।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এ আয়োজন থেকে ফিলিস্তিনের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ান হাসান গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়ে শহিদুল আলমসহ সবার মুক্তি দাবি করেন। তিনি বলেন, ফিলিস্তিন একদিন মুক্ত হবেই। সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গুণীজনদের নিয়ে এমন আয়োজন করে যাবে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অভিনেতা আফজাল হোসেন ও মারিয়া সারাহ উপমা।
অনুষ্ঠানে মঞ্চের দুই পাশে বসানো হয়েছিল বিশাল ডিজিটাল পর্দা। উপস্থিত শ্রোতারা ঘুরেফিরে আয়োজন উপভোগ করেছেন। রাত সোয়া ১১টা অবধি চলে অনুষ্ঠান।
প্রসঙ্গত, ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন ত্রিপুরা প্রদেশের শিবপুর গ্রামে (বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর) জন্মগ্রহণ করেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। শৈশবে ‘আলম’ নামে পরিচিত আলাউদ্দিন খাঁ ছোটবেলা থেকেই সুর ও প্রকৃতির প্রতি ছিলেন গভীর অনুরাগী।
আগরতলার রাজদরবারের সভাসংগীতজ্ঞ ও তানসেন বংশীয় রবাবী ওস্তাদ কাশিম আলী খাঁ ছিলেন তার গুরু। দশ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাত্রাদলে যোগ দেন তিনি, যেখানে জারি, সারি, বাউলসহ বাংলার নানা লোকগানের সঙ্গে পরিচিত হন। পরে কলকাতায় গিয়ে প্রখ্যাত সঙ্গীতসাধক গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের শিষ্যত্ব নেন।
গুরুর মৃত্যুর পর যন্ত্রসংগীতে মনোযোগ দেন আলাউদ্দিন খাঁ। বাঁশি, সেতার, বেহালা, তবলাসহ বহু বাদ্যযন্ত্রে অসাধারণ পারদর্শিতা অর্জন করেন।
সংগীতে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন ‘সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার’ (১৯৫২), ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৫৮), ‘পদ্মবিভূষণ’ (১৯৭১), ‘বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম’ উপাধি। ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের মাইহারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই সংগীত সাধক।
এলআইএ/জিকেএস