শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সমাজে এখনো রয়েছে দ্বিধা ও ভুল ধারণা। অনেকেই মনে করেন, শিশুরা হয়তো মানসিক চাপ বোঝে না বা তা তাদের প্রভাবিত করে না। কিন্তু বাস্তবে শিশু-কিশোররাও স্বতন্ত্র মানুষ, তাদেরও মানসিক বিকাশ, আবেগীয় প্রতিক্রিয়া ও চাপ মোকাবিলার নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে— এমনটাই জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাদিয়া আফরিন।
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) জাগোনিউজ২৪.কম আয়োজিত ‘বিপর্যয়-জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে এ কথা বলেন তিনি। জাগো নিউজের প্রধান কার্যালয়ে এ গোলটেবিলের আয়োজন করা হয়।
জাগোনিউজ২৪.কম-এর সম্পাদক কে এম জিয়াউল হকের সভাপতিত্বে ও প্ল্যানিং এডিটর মনিরুজ্জামান উজ্জ্বলের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. নিলুফার আখতার জাহান, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুনতাসির মারুফ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মেজবাউল ইসলাম, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. এস এম জিকরুল ইসলাম, সাইক্রিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার জামাল হোসেন, সিনিয়র স্টাফ নার্স শফিউল আজম এবং মনের বন্ধুর সিনিয়র কাউন্সিলর মেহেদী মোবারক আমান।
বৈঠকে শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাদিয়া আফরিন বলেন, ‘শিশু-কিশোররা কোনোভাবেই প্রাপ্তবয়স্কদের ছোট সংস্করণ নয়। তাদের বিকাশের প্রতিটি ধাপেই আলাদা মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা রয়েছে। সেই বিকাশের ধাপে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস একটি স্বাভাবিক বিষয়— কিন্তু যখন সেই চাপ তাদের দৈনন্দিন কাজ, পড়াশোনা বা সামাজিক সম্পর্ককে ব্যাহত করে, তখনই সেটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় রূপ নেয়।’
আরও পড়ুনলাফ দিয়ে পুলিশ সদস্যের আত্মহত্যাচেষ্টা, গোড়ালি বিচ্ছিন্নমানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রসারে দরকার সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব
ডা. সাদিয়া বলেন, মানসিক চাপের প্রকাশ শিশুর আচরণের মধ্যদিয়েই ধরা পড়ে। ‘যেমন, হঠাৎ করে স্কুলে না যেতে চাওয়া, বন্ধুদের এড়িয়ে চলা, ঘুমের সমস্যা, খাওয়ায় অরুচি, অতিরিক্ত রাগ বা কান্নাকাটি করা— এসব পরিবর্তনই অনেক সময় স্ট্রেস বা মানসিক চাপে ভোগার ইঙ্গিত দেয়।’
জাগো নিউজ আয়োজিত ‘বিপর্যয়-জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক
মোবাইল ও ইন্টারনেট আসক্তি: আধুনিক সময়ের বড় ঝুঁকিতিনি বলেন, মোবাইল ও ইন্টারনেট আসক্তি এখন শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির অন্যতম কারণ। শিশুর বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়েই শান্ত রাখার জন্য হাতে মোবাইল তুলে দেওয়া হয়, যা মূলত একমুখী যোগাযোগ তৈরি করে। এতে শিশুর আবেগীয় ও সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে দেখা দেয় স্পিচ ডিলে, আচরণগত পরিবর্তন ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি।
কিশোর বয়সে এটি আরও জটিল আকার ধারণ করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বন্ধুদের প্রভাবে মোবাইলের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা তৈরি হয়, যা ধীরে ধীরে গেমিং বা সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তিতে রূপ নেয়। ফলে পড়াশোনায় অনাগ্রহ, ঘুমের ব্যাঘাত, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, এমনকি ডিপ্রেশনও তৈরি হয়।’
প্রতিরোধই সর্বোত্তম সমাধানসমস্যার সমাধান হিসেবে ডা. সাদিয়া আফরিন বলেন, ‘প্রতিরোধই সর্বোত্তম ব্যবস্থা। বাচ্চাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করতে হবে— কখন পড়বে, খেলবে, বিশ্রাম নেবে, কতটা সময় মোবাইল ব্যবহার করবে— এসব বিষয় স্পষ্ট করতে হবে।’
আরও পড়ুনপড়ালেখার ধরন বদলে যাওয়ায় মানসিক চাপে শিশু শিক্ষার্থীরা
অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহারে সতর্ক তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তাদের আউটডোর ও সৃজনশীল কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে। বিকল্প আনন্দ ও আগ্রহের সুযোগ না পেলে সহজেই ডিজিটাল নির্ভর হয়ে পড়ে শিশুরা।
চিকিৎসা ও পরামর্শএরই মধ্যে যারা ইন্টারনেট বা মোবাইল আসক্তিতে ভুগছে, তাদের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, ‘সাইকিয়াট্রিক চিকিৎসায় আমরা কেবল আসক্তি দেখি না— এর পেছনে থাকা বিষণ্নতা, উদ্বেগ বা বিকাশজনিত সমস্যা খুঁজে বের করি। কাউন্সেলিং, বিহেভিয়ার মডিফিকেশন থেরাপি ও পজিটিভ প্যারেন্টিং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব শিশু-কিশোরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’
শেষে ডা. সাদিয়া আফরিন বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা শুধু চিকিৎসকের দায়িত্ব নয়— পরিবার, স্কুল ও সমাজকেও এতে সম্পৃক্ত হতে হবে। মানসিকভাবে সুস্থ প্রজন্মই হতে পারে ভবিষ্যতের শক্তিশালী মানবসম্পদ।’
এসইউজে/এমএএইচ/জিকেএস