আন্তর্জাতিক

ইসরায়েল কেন বারঘুতিকে ছাড়তে ভয় পায়?

গাজা যুদ্ধবিরতির নতুন বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় জনপ্রিয় ফিলিস্তিনি নেতা মারওয়ান বারঘুতিকে মুক্তি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরায়েল। মূলত তাকে ছাড়তে ভয় পাচ্ছে দখলদার বাহিনী। কিন্তু কেন?

শনিবার (১১ অক্টোবর) দেশটির কর্মকর্তারা জানান, ইসরায়েল যে ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিতে যাচ্ছে, সেই তালিকায় বারঘুতির নাম নেই। অথচ হামাস দীর্ঘদিন ধরেই বারঘুতির মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছে।

হামাসের শীর্ষ আলোচক মুসা আবু মারজুক আল জাজিরাকে জানান, তারা এখনো বারঘুতির মুক্তির জন্য মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ইসরায়েল বারঘুতিকে ‘সন্ত্রাসী নেতা’ হিসেবে বিবেচনা করে। ২০০৪ সালে পাঁচজনকে হত্যার দায়ে তাকে একাধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন>>অবশেষে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করলো ইসরায়েলইসরায়েলি ড্রোন-বোমা বিস্ফোরণের শব্দ ছাড়াই রাত কাটালো ফিলিস্তিনিরাঝুঁকি নিয়ে ট্রাম্পের কাঁধেই হাত রাখলো হামাস, কারণ কী?

তবে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের প্রধান উদ্বেগ বারঘুতির রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে। পশ্চিম তীরের ফাতাহ নেতা বারঘুতি একদিকে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে কথা বলেছেন, অন্যদিকে দখলবিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধেও সমর্থন দিয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের কাছে তিনি এক অনন্য ঐক্যের প্রতীক; অনেকেই তাকে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে তুলনা করেন।

জরিপে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের পরবর্তী নেতৃত্বের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বারঘুতিই সবচেয়ে জনপ্রিয়।

হামাস বারবার বলেছে, বড় ধরনের কোনো বন্দিবিনিময় হলে তাতে বারঘুতির নাম অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু ইসরায়েল এখনো সে দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছে। এর একটি কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা—২০১১ সালের বন্দিবিনিময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার পরবর্তীতে সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বে উঠে আসেন এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হন।

কে এই মারওয়ান বারঘুতি?

৬৬ বছর বয়সী বারঘুতি পশ্চিম তীরের কুবার গ্রামের বাসিন্দা। বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে তার উত্থান। প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় তিনি সক্রিয় ছিলেন এবং ১৯৯০-এর দশকের শান্তি প্রক্রিয়ার সময় পশ্চিম তীরে ফিরে আসেন।

দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ফাতাহর পশ্চিম তীর শাখার প্রধান হিসেবে ইসরায়েল তাকে আল-আকসা শহিদ ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ তোলে, যদিও তিনি তা অস্বীকার করেন। আদালতের কর্তৃত্ব মানতে অস্বীকার করায় তাকে একাধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বন্দি অবস্থায়ও বারঘুতি ফিলিস্তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। ২০২১ সালে তিনি সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী তালিকা জমা দেন, যা পরে স্থগিত হয়। তিনি বন্দিদের অধিকার আদায়ে ৪০ দিনের অনশন আন্দোলনও পরিচালনা করেন।

বিশ্লেষকদের মতে, বারঘুতি ফিলিস্তিনের সব গোষ্ঠীর মধ্যেই জনপ্রিয়। তার মুক্তি ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে শক্তিশালী করতে পারে—যা ইসরায়েলের ডানপন্থি সরকার এবং এমনকি মাহমুদ আব্বাসের জন্যও রাজনৈতিকভাবে অস্বস্তিকর হবে।

সবশেষ গত আগস্ট মাসে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থি মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির বারঘুতির সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাতের ভিডিও প্রকাশ করেন এবং সতর্ক করে বলেন, ‘যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কাজ করবে, তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে।’

কারা রয়েছেন বন্দি বিনিময়ের তালিকায়?

চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় হামাস কয়েক দিনের মধ্যেই প্রায় ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে, আর ইসরায়েল মুক্তি দেবে প্রায় ২৫০ ফিলিস্তিনি বন্দি এবং গত দুই বছরে গাজা থেকে আটক ১ হাজার ৭০০ জনকে, যাদের অনেকেই কোনো অভিযোগ ছাড়াই বন্দি রয়েছেন। এই বিনিময় উভয় পক্ষেই প্রতীকী গুরুত্ব বহন করছে— ইসরায়েলিদের কাছে এরা সন্ত্রাসী, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কাছে তারা রাজনৈতিক বন্দি বা প্রতিরোধযোদ্ধা।

ইসরায়েলের প্রকাশিত তালিকায় মূলত হামাস ও ফাতাহর সদস্যরা রয়েছেন, যারা ‘দ্বিতীয় ইন্তিফাদার’ সময় গুলি, বোমা হামলা ও অন্যান্য সহিংস কর্মকাণ্ডের অভিযোগে দণ্ডিত। যাদের মুক্তি দেওয়া হবে, তাদের কেউ কেউ গাজায় পাঠানো হবে, আবার কেউ নির্বাসনে যাবেন।

মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন ইসলামিক জিহাদের কমান্ডার ইইয়াদ আবু আল-রুব, যিনি ২০০৩–২০০৫ সালে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১৩ জন নিহতের ঘটনায় দণ্ডিত। সবচেয়ে প্রবীণ বন্দি ৬৪ বছর বয়সী সামির আবু নাআমা, যিনি ১৯৮৬ সালে গ্রেফতার হন। সবচেয়ে কনিষ্ঠ বন্দি মোহাম্মদ আবু কাতিশ, যিনি ২০২২ সালে ১৬ বছর বয়সে গ্রেফতার হয়ে ছুরিকাঘাতের চেষ্টা মামলায় দণ্ডিত হন।

সূত্র: ইউএনবিকেএএ/