জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবাদুল্লাহ খান। নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অব টোয়েন্টে থেকে দুই বছরের মাস্টার্স অব সায়েন্স (এমএসসি) ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং জাবির অর্থায়নে পরিবেশ বিষয়ক নানা গবেষণা প্রকল্পের প্রধান গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
এবাদুল্লাহ খান বাংলাদেশ জাতীয় ভূগোল সমিতির (বিএনজিএ) আজীবন সদস্য। একাডেমিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে তিনি পরিবেশ বিষয়ক নানা প্রবন্ধ রচনা করেছেন। বিশেষত, ল্যান্ডস্কেপের গঠন ও প্রক্রিয়া, উপকূল ও বনভূমির স্থানিক ও গঠনগত বিশ্লেষণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত গবেষণায় তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। রয়েছে আন্তর্জাতিক গবেষণাও। সম্প্রতি গবেষণা করেছেন সুন্দরবন নিয়ে। এসব বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
জাগো নিউজ: আবহাওয়া ও জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশ কেমন ঝুঁকিতে আছে?
এবাদুল্লাহ খান: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন আইপিসিসি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ)। তারা প্রাথমিকভাবে বলছেন যে, ভবিষ্যতে উন্নত কোস্টাল কান্ট্রি যেগুলো আছে, অর্থাৎ উপকূলীয় যে দেশগুলো আছে, সেগুলোতে আগামী বছরগুলোতে তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। সেটা হতে পারে ৫° সেলসিয়াস থেকে ১০° সেলসিয়াস (অনির্দিষ্ট)। উপকূলীয় দেশগুলোর একটা বেশিরভাগ অংশ সমুদ্রের পানির নিচে নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলে বরফ গলে যাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। তাই বৈশ্বিক দিক থেকে দেখলে সি লেভেল বৃদ্ধির হলে উপকূলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশও একটি ঝুঁকিতে থাকবে।
জাগো নিউজ: প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সুন্দরবনের ভূমিকা ও গুরুত্ব কেমন?
এবাদুল্লাহ খান: উপকূলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সুন্দরবনের একটা বিশাল গুরুত্ব আছে। এই সুন্দরবনকে আমরা আলাদা একটা ইকোলজিক্যাল ইউনিট হিসেবে চিন্তা করতে পারি। বাংলাদেশকে আমরা কতগুলো ছোট ছোট ইকোলজিক্যাল ইউনিটে ভাগ করলে সুন্দরবনও একটা পুরো ইকোলজিক্যাল ইউনিট। এখান থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস পাই।
এই ম্যানগ্রোভস আমাদের জন্য একটা গার্ড হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়—এ জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর সময় বাতাসের যে ভেলোসিটি বা বেগ থাকে, এটি সেই বেগটাকে প্রশমিত করে। সমুদ্রের উপকূলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের সময় সমুদ্রের পানির যে স্ট্রম ওয়েভ অ্যাকশন, সেটা প্রোটেক্ট করে। নদীর স্রোতের সঙ্গে আসা পলিগুলো সুন্দরবনের কারণেই স্থায়ী হচ্ছে এবং নতুন জায়গা তৈরি হচ্ছে, না হয় সেগুলো সমুদ্রে চলে যেত। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের যে ইকোসিস্টেম সেটাকে বিদ্যমান রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে সুন্দরবন।
অনেক ধরনের বায়োকেমিক্যাল এবং নিউট্রিয়ান সাইকেল আছে। এই সাইকেলগুলোকে বিদ্যমান রাখার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করছে সুন্দরবন। এটা একটা ব্রিজের মতো; যেটা অশ্বমণ্ডল, নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডল—এ তিনটির সমন্বয় করে।
জাগো নিউজ: নানা কারণে যে পরিবর্তনগুলো ঘটছে, এই পরিবর্তনে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর কেমন প্রভাব পড়ছে?
এবাদুল্লাহ খান: আমার কাজ ছিল সুন্দরবনের ডিস্টার্বেন্সটাকে (বাধা) তুলে আনার চেষ্টা করা। সেটা আমি দেখেছি জিআইএস এবং রিমোট সেন্সিং টেকনিক অ্যাপ্লাই এবং দীর্ঘ একটা টাইম সিরিজ বিশ্লেষণ করে। এতে ম্যানগ্রোভ বনের বাংলাদেশের যে অংশটি রয়েছে, আমরা সেখানে দুই ধরনের ডিস্টার্বেন্স লক্ষ্য করেছি। একটি হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অর্থাৎ সাইক্লোন-টর্নেডো জাতীয় সমস্যার কারণে। আরেকটি হচ্ছে মানবসৃষ্ট ডিস্টার্বেন্স।
বিভিন্ন ডিস্টার্বেন্সে ফলে উদ্ভিদের ঘনত্ব কমে যাওয়ায় জোয়ারে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি বনের অনেক ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের নদীগুলো থেকে অর্থাৎ ওপর থেকে যে ফ্রেশ ওয়াটারের চাপ আসার কথা ছিল, বিভিন্নভাবে বাঁধ নির্মাণের কারণে সেটিও কমে গেছে। যার ফলে সুন্দরবনের মাটি ও পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতে করে উদ্ভিদ প্রজাতি অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।গাছের সঠিক ডিস্ট্রিভিউশন ব্যাহত হচ্ছে। কারণ, বিশেষ কিছু উদ্ভিদ এবং বিশেষ প্রজাতির প্রাণীগুলো একটা নির্দিষ্ট মাত্রার স্যালাইনিটি (লবণাক্ততা) সহ্য করতে পারে। সবমিলিয়ে ম্যানগ্রোভসের বাংলাদেশ অংশের জন্য একটা ঝুঁকি রয়েছে, যেটার অনেকটাই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া সম্পর্কিত কারণে হচ্ছে।
জাগো নিউজ: পরিবেশের পাশাপাশি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে?
এবাদুল্লাহ খান: উদ্ভিদ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি প্রাণী প্রজাতিরও আবাসস্থল কমে যাচ্ছে। ম্যানগ্রোভের ভেতরে কয়েক মাত্রা স্যালাইনিটি নির্ধারিত হয়— উচ্চ লবণাক্ত অঞ্চল, মাঝারি লবণাক্ত অঞ্চল এবং নিম্ন লবণাক্ত অঞ্চল। বিভিন্ন ধরনের ক্ষতির ফলে গাছ কমে যাওয়ায় লবণাক্ত পানি বনের অনেক ভেতরে পর্যন্ত চলে যায়, যেখানে স্যালাইনিটির ধারণ ক্ষমতা কম। গাছ কমে যাওয়ার কারণে প্রাণীদের বিচণের জায়গাও দিন দিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এসবের কারণে কিছুদিন পর পর আবাসস্থল পরিবর্তন এবং কিছুটা নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাণীদেরও এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া পর্যটন কেন্দ্রের ফুট ট্রেইলে বাঘের বিচরণসুন্দরবনে নষ্ট হচ্ছে জব্দ হাজারো নৌকা-ট্রলারপর্যটনে অপার সম্ভাবনায়ও উপেক্ষিত সাতক্ষীরাসুন্দরবনে বিষ চক্রের নতুন ফাঁদ শামুক পাচারসুন্দরবন ভ্রমণে যা যা দেখবেন
মানুষ ঘুরতে গিয়ে, ভেতরের খালগুলোতে মাছ চাষ করতে গিয়ে, মধু সংগ্রহ করতে গিয়েও উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের ক্ষতি করে। যার ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
জাগো নিউজ: আপনার গবেষণাটির টাইম ফ্রেম কত সময়ের এবং সেখানে কী পরিমাণ ডিস্টার্বেন্স দেখেছে?
এবাদুল্লাহ খান: আমার গবেষণাটির টাইম ফ্রেম ছিল ১৯৮৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। সেখানে আমরা দেখেছি, ম্যানগ্রোভ বন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০০৬ থেকে ২০০৯, এই সময়টাতে। ২০০৬ সালে ১৫ হাজার ৪৪৬ হেক্টর, ২০০৭ সালে সাত হাজার ২১৭ হেক্টর, ২০০৮ সালে আট হাজার ১৬৩ হেক্টর এবং ২০০৯ সালে দুই হাজার ৪৩১ হেক্টর জায়গায় ডিস্টার্বেন্স সংঘটিত হয়েছে। যার কারণ হচ্ছে এই ইয়ারগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি সংঘটিত হয়েছে।
জাগো নিউজ: আপনি কোন কোন অঞ্চলে এই ডিস্টার্বেন্সটা বেশি দেখেছেন?
এবাদুল্লাহ খান: শহরের কাছাকাছি জায়গাগুলোতে ডিস্টার্বেন্সের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। যেমন-খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলে এটির মাত্রাটা বেশি। এছাড়া বনের ভেতরে থাকা খাল এবং চ্যানেলগুলোর আশেপাশেও ডিস্টার্বেন্সর মাত্রা বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
জাগো নিউজ: সুন্দরবন রক্ষায় জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?
এবাদুল্লাহ খান: সুন্দরবনকে জোনিন অর্থাৎ অঞ্চলভেদে ভাগ করতে অভয়ারণ্যকে অভয়ারণ্যের জায়গায় রাখতে হবে, যেখানে মানুষের কোনো ধরনের প্রবেশ থাকবে না। শুধুমাত্র যেটুকু অঞ্চলে মানুষের প্রবেশের সুযোগ আছে সেটুকু অঞ্চলে যাবে। সুন্দরবনের ভেতরে থাকা নদীগুলোর নাব্য নিয়ে আসতে হবে, যাতে করে ওপর থেকে আসা পানিটা ভালোভাবে প্রবাহিত হতে পারে।
জীববৈচিত্র্য ঠিক রাখার জন্য ম্যানগ্রোভের আরেকটা অংশ অর্থাৎ ইন্ডিয়ার সঙ্গে কো-অর্ডিনেশনটা জরুরি। কারণ বন্যপ্রাণীরা তো এক জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে না, তারা দুদিকেই বিচরণ করে। তারা কী ধরনের পলিসি মেইনটেন করছেন, সেগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকা। এতে করে প্রাণী বিলুপ্তি রোধ পাবে।
মানুষ কী করতে পারবে আর কী করতে পারবে না—এই মর্মে যে নীতিমালা সেটি যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। পর্যটকদের জন্য রুফ ইকো ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যেটা বিভিন্ন দেশে রয়েছে। তাহলে মানুষ ওপর থেকেই বনটা দেখতে পাবে, ভেতরে গিয়ে উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীকূলের কোনো ক্ষতি বা ডিস্টার্বেন্সের কারণ হতে হবে না।
জাগো নিউজ: ব্যস্ততার মাঝেও গুরুত্বপূর্ণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এবাদুল্লাহ খান: জাগো নিউজকেও ধন্যাবাদ।
এসআর/এমএস