মো. সুলতান মাহমুদ কুমিল্লার দেবিদ্বারের সন্তান। পরিবারের আট ভাই-বোনের মধ্যে ষষ্ঠ। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করেছেন। পাশাপাশি স্নাতকোত্তরে পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগে। বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় হয়ে বিসিএস ক্যাডার হবেন। সুলতান স্নাতক পাসের পর সেই স্বপ্নপূরণে নেমে পড়েন। বাবা বেঁচে না থাকলেও তার স্বপ্নকে ধরতে পেরেছেন। ৪৪তম বিসিএসে মৎস্য ক্যাডারে নিজের নাম লিখিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি শৈশব ও পড়াশোনার পাশাপাশি মৎস্য ক্যাডার হওয়ার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে বলুন—মো. সুলতান মাহমুদ: আমার বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বড়শালঘর ইউনিয়নের ইষ্টগ্রামে। বাবার অনুরোধে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমার নাম মো. সুলতান মাহমুদ রাখেন। প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি রুমা দিদির কাছে। আমার বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন বাবাকে হারাই। বাবার পেনশনই ছিল পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। আম্মা আমাদের জন্য কষ্টে জীবনযাপন করেছেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও পড়াশোনা চালিয়ে নিয়েছেন। মা সব সময় বলতেন, ‘প্রয়োজনে না খেয়ে থেকো, তবু মানুষের সম্পদের প্রতি লোভ করবে না। আল্লাহ কখনো মানুষকে না খাইয়ে মারেন না।’ তিনি বলতেন, ‘অফিসার হতে হলে রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে শিখতে হবে।’ আমার বড় ভাইও আমাদের গড়ে তুলতে প্রচুর পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনে দৃঢ়তা পেয়েছি। বড় হয়ে দেশের সেবা করার শিক্ষা পেয়েছি। অষ্টম শ্রেণি থেকেই টিউশন পড়ানো শুরু করি। যাতে পড়াশোনার খরচ কিছুটা সামলানো যায়। স্কুলের ফি দেওয়ার মতো আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না কিন্তু শিক্ষকেরা সব সময় পাশে ছিলেন।
জাগো নিউজ: আপনার পড়াশোনা সম্পর্কে বলুন—মো. সুলতান মাহমুদ: মাধবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি সম্পন্ন করি। স্কুলজীবনে টপার ছিলাম। অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছি। আমাদের স্কুলের ‘বেস্ট স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছি। বাবার প্রিয় শিক্ষক শ্রদ্ধেয় শ্রী মাখন লাল শিব স্যার এবং বাবার বন্ধু শ্রদ্ধেয় শ্রী কানু চন্দ্র ভট্টাচার্য স্যার বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন। এরপর অধ্যাপক আব্দুল মজিদ কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করি। কলেজ জীবনে পড়াশোনার প্রতি শ্রদ্ধেয় শেখ মশিউর রহমান স্যার, শাহজালাল স্যার, মোতাহার হোসেন স্যার এবং হাবিবুর রহমান স্যারসহ শিক্ষকগণের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের আন্তরিক নির্দেশনা ও অকৃত্রিম স্নেহ শিক্ষাজীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
জাগো নিউজ: ৪৪তম বিসিএসে মৎস্য ক্যাডার পেয়েছেন, অনুভূতি কেমন?মো. সুলতান মাহমুদ: স্নাতক পরীক্ষা শেষ করে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসি। অ্যাপিয়ার্ড হিসেবে বিসিএসে আবেদন করি। বিসিএস প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হই। পরে সফলতার সঙ্গে লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম বিসিএসে মৎস্য ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। যখন ফাইনাল রেজাল্টে নিজের রোল দেখতে পাই; তখন অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি ঝরছিল। সেই মুহূর্তে হৃদয় কৃতজ্ঞতায় ভরে যায়—সবকিছুর জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করি।
জাগো নিউজ: বিসিএস পরীক্ষা দেবেন এমন ভাবনা মাথায় এলো কীভাবে?মো. সুলতান মাহমুদ: বাবার ইচ্ছে ছিল, তিনি যেন একজন বিসিএস ক্যাডারের বাবা হন। বাবা সব সময় মাকে বলতেন, ‘আল্লাহর কাছে দোয়া করো, যেন আমরা একজন বিসিএস ক্যাডারের পিতা-মাতা হতে পারি।’ ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই আমার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নের শুরু। পরে যখন স্নাতক পর্যায়ে থিসিস নিয়ে কাজ করছিলাম; তখন দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুঃখ-কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমি প্রত্যক্ষ করেছি, নদী-নালা, খাল-বিল নষ্ট হওয়ার ফলে তাদের জীবনে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে। তাদের ছেলেমেয়েরা যথাযথ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষা এবং দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার গভীর ইচ্ছা থেকেই বিসিএস প্রস্তুতি শুরু করি।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?মো. সুলতান মাহমুদ: বিসিএস প্রস্তুতির শুরু ২০২০ সালে। করোনার লকডাউনে। ঘরে বসেই নিয়মতান্ত্রিকভাবে রুটিন করে পড়াশোনা শুরু করি। প্রিলিমিনারি প্রস্তুতির মূলমন্ত্র ছিল লেখা-পড়া-রিভিশন দেওয়া এবং আবার চালিয়ে যাওয়া। প্রস্তুতির শুরুতে প্রতিদিন ৫ জন বাংলা সাহিত্যিক ও ৫ জন ইংরেজি সাহিত্যিক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত নোট করতাম। নোটগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। নিয়মিত রিভিশন দিতাম এবং মনে করার চেষ্টা করতাম। ধীরে ধীরে সব বিষয় সম্পন্ন করি। যখন প্রায় ৭০-৮০% প্রস্তুতি শেষ হয়; তখন জব সল্যুশন এবং মডেল টেস্ট দেওয়া শুরু করি। নিয়মিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার ফলে ভুল ও নেগেটিভ মার্ক ধীরে ধীরে কমে আসে। ফলে আল্লাহর রহমতে ৪৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি। বিসিএস লিখিতের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ হওয়ার পর মার্কেটের ভালো বইগুলো থেকে টপিকভিত্তিক নোট তৈরি করি। আন্তর্জাতিক জার্নাল ও নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেও তথ্য সংগ্রহ করি। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি বিষয়ে শিট আকারে নোট তৈরি করি। নিয়মিত শিটগুলো রিভিশন দিতাম। পরীক্ষার আগে শুধু শিটগুলো রিভিশন করেই প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়—নতুন বই পড়ার প্রয়োজন হয়নি। আল্লাহর অশেষ রহমতে, সহজেই লিখিত পরীক্ষায়ও উভয় ক্যাডারে যোগ্যতা অর্জন করি। এরপর শুরু হয় বিসিএস ভাইভা প্রস্তুতি। ভাইভার জন্য বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতি নিয়েছি। নিয়মিত সংবাদপত্র ও চলতি ঘটনা পড়তাম। মানসিকভাবে নিজেকে আত্মবিশ্বাসী ও শান্ত রাখার চেষ্টা করেছি। ফলে ৪৪তম বিসিএসে মৎস্য ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই।
আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্রে স্কলারশিপ পেতে চান, রইলো ফয়সালের পরামর্শবিদেশে পড়তে যাওয়ার পর যেসব বিষয় জানা জরুরি
জাগো নিউজ: বিসিএস জার্নিতে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন?মো. সুলতান মাহমুদ: স্নাতক শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষার সময় দুইবার টাইফয়েডে আক্রান্ত হই। যদি তখন কোনো পরীক্ষা মিস করতাম, তাহলে অ্যাপিয়ার্ড হিসেবে আবেদনের সুযোগ পেতাম না। তাই ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়েও পরীক্ষায় অংশ নিই। হাসপাতাল থেকে গিয়ে পরীক্ষা দিতাম। এসে হাসপাতালে যেতাম। হাসপাতালে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে স্নাতক পরীক্ষা সম্পন্ন করি। বিসিএস পরীক্ষায় ‘অ্যাপিয়ার্ড’ হিসেবে আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করি।
জাগো নিউজ: আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?মো. সুলতান মাহমুদ: মা, বড় ভাই, বড় বোন, পরিবারের সব সদস্য, আত্মীয়-স্বজন এবং শিক্ষকেরা ছিলেন অনুপ্রেরণা। তারা সব সময় সাহস জুগিয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন। কঠিন মুহূর্তে আমার পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছেন।
জাগো নিউজ: নতুনদের বিসিএস প্রস্তুতি নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?মো. সুলতান মাহমুদ: এখন বিসিএস প্রিলিমিনারি অনেক কঠিন। প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। তাই যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায়, ততই ভালো। যদি এখন থেকেই শুরু করেন, তাহলে বড় অ্যাডভান্টেজ পাবেন। সময়মতো রিভিশন, প্রতিদিন অল্প হলেও নিয়মিত পড়া এবং সঠিক গাইডলাইন মেনে পড়লে প্রিলিতে ভালো করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। প্রিলিমিনারির প্রস্তুতির জন্য ১২টি বইকে ৪টি ধাপে ভাগ করে পড়া যায়। যা ১২ মাসের পরিকল্পনা। প্রিলিতে সাধারণত ২০০ নম্বরের জন্য ১২টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে প্রশ্ন আসে। ১ম ধাপের ১ম ৩ মাসে যে কোনো ৪টি বই বেছে নিন। ভালোভাবে একবার পড়ে শেষ করুন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ করে বেসিক ক্লিয়ার করুন। ২য় ধাপের ৩ মাসে আরও ৪টি বই নিন। বিষয়গুলোও একবার করে শেষ করুন। আগের পড়াগুলো সপ্তাহে ১ দিন রিভিশন হিসেবে দেখে নিতে পারেন।
৩য় ধাপের ৩ মাসে বাকি থাকা ৪টি বই পুরোপুরি পড়ে ফেলতে হবে। আগের ৮টি বইয়ের সংক্ষিপ্ত রিভিশন চালিয়ে যেতে পারেন। এতে আগের বইগুলো নখদর্পণে চলে আসবে। ৪র্থ ধাপের ৩ মাস বা পরীক্ষার আগের সময় ১২টি বই বারবার রিভিশন দিন। বিগত সালের প্রশ্ন নিয়মিত চর্চা করুন। প্রতিদিন কিছু লিখিত চর্চাও করা যায়। বিশেষ করে বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান, ইত্যাদি। কেউ চাইলে সময় আরও কমিয়ে নিতে পারেন। তবে এ কৌশলের সুবিধা হলো—একবারে অনেক কিছু পড়ার চাপ পড়বে না। সময় ভাগ করে পড়লে মনে থাকবে বেশি দিন। শেষের সময়টায় প্রচুর রিভিশন ও মক টেস্ট দেওয়া সম্ভব হবে। আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
ঠিক এভাবে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলে বিসিএস রিটেন এবং ভাইভা—দুটোতেই ভালো করা সম্ভব। আমরা অনেক সময় বিসিএস পরীক্ষা দিতে ভয় পাই, মনে হয়—এত পরিশ্রম করেও যদি সফল হতে না পারি! কিন্তু আসলে এই ভয় আমাদের পিছিয়ে দেয়, সফলতার পথ বন্ধ করে দেয়। মনে রাখতে হবে, প্রচেষ্টা কখনো বৃথা যায় না। যদি সফল না-ও হই, তবুও এই বিসিএস যাত্রা আমাদের একজন ধৈর্যশীল ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। ভবিষ্যতে যখন যে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবো, তখন আমরা তা আরও সহজে সামাল দিতে পারবো। তাই নতুনদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই—‘ভয়কে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে দেবেন না।’
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?মো. সুলতান মাহমুদ: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো—দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করা। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চাই। যাতে তারাও সমানভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের সুযোগ পান। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনাই আমার মূল লক্ষ্য।
এসইউ/জেআইএম