অর্থনীতি

ডোম-ইনোর বিলুপ্তি চেয়ে মামলা, সম্পদ বেচে পাওনা মেটানোর দাবি

অভিযোগে জর্জরিত নামি আবাসন কোম্পানি ডোম-ইনো। ফ্ল্যাট বিক্রি করে বুঝিয়ে না দেওয়া, জমির মালিকদের সঙ্গে প্রতারণা, জালিয়াতি, মানি লন্ডারিংসহ বিভিন্ন অভিযোগে ডোম-ইনোর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে আড়াইশর বেশি। প্রতিষ্ঠানটির বিলুপ্তি (অবসায়ন) দাবি করেও হাইকোর্টে একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা করেছেন প্রতারণার শিকার বিনিয়োগকারীরা।

মামলায় ভুক্তভোগীরা আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, ডোম-ইনোর সব সম্পদ বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ন্যায্য অর্থ ফেরত দেওয়ার আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আদালত ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের পক্ষে রায় দেবেন বলে আশাবাদী আইনজীবী।

ভুক্তভোগী ও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৫ বছরে ১৪২টি প্রকল্পে ডোম-ইনোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে অন্তত ৫৬টি প্রকল্পে সব ফ্ল্যাট বিক্রি করেও হস্তান্তর করা হয়নি। বুঝিয়ে না দেওয়া ফ্ল্যাটের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। গ্রাহকের বিনিয়োগের পরিমাণ তিন হাজার কোটি টাকার ওপরে।

এ সংক্রান্ত মামলা নিয়ে কথা হয় আইনজীবী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে। ছয়জন প্রতারিত ফ্ল্যাট ক্রেতার পক্ষে মামলায় লড়ছেন তিনি। নজরুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘এর আগে ডোম-ইনোর বিরুদ্ধে প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ ও জালিয়াতির অভিযোগে বিভিন্ন থানা এবং নিম্ন আদালতে শত শত মামলা হয়েছে। কিন্তু এবার প্রথমবারের মতো কোম্পানিটি বিলুপ্ত করে তার সম্পদ নিলামে তুলে ক্ষতিগ্রস্তদের পাওনা ফেরত দিতে হাইকোর্টে মামলা করা হয়েছে।’

এই মামলা ডোম-ইনোর ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এখানে আদালত কোম্পানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারেন— কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা, লিকুইডেটর নিয়োগ ও সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে পাওনাদারদের অর্থ ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন।- অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান

হাইকোর্টের বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর কোর্ট মামলাটি শুনানির জন্য গ্রহণ করেছেন জানিয়ে অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এই মামলা ডোম-ইনোর ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এখানে আদালত কোম্পানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারেন— কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা, লিকুইডেটর নিয়োগ ও সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে পাওনাদারদের অর্থ ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন।’

একাধিক ভুক্তভোগী এ মামলায় যুক্ত হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে ছয়জন ক্রেতা মামলায় বাদী থাকলেও এখন আরও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মামলায় পক্ষভুক্ত (intervener) হওয়ার জন্য আবেদন প্রস্তুত করছেন। নতুন আবেদনগুলো শিগগির কোর্টে জমা দেওয়া হবে। জানান অ্যাডভোকেট নজরুল।

ডোম-ইনোর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- অগ্রিম অর্থ গ্রহণ করে ফ্ল্যাট না দেওয়া, প্রকল্পের কাজ বন্ধ রেখে পালিয়ে যাওয়া, জমির মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করেও প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বন্ধক রাখা ফ্ল্যাট পরবর্তীসময়ে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া, নথি জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিং।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র জানায়, ডোম-ইনো প্রকল্পের এমডি আবদুস সালাম ক্রেতাদের টাকা আত্মসাৎ করে তা বিদেশে পাচার করেছেন এবং সেই অর্থ ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন, যার মধ্যে লিওন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড অন্যতম। দুর্নীতি মামলায় একসময় তিনি কারাবন্দি থাকলেও পরে জামিনে মুক্তি পান। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করলেও একটা মামলায় আটকে যান তিনি। বর্তমানে কারাগারে।

আমাদের লক্ষ্য প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচার। যেন আদালতের নির্দেশে কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে প্রকৃত ভুক্তভোগীদের পাওনা ফেরত দেওয়া যায়।- অ্যাডভোকেট নজরুল

রিহ্যাব ও বিভিন্ন থানার তথ্য অনুযায়ী, ডোম-ইনোর বিরুদ্ধে ২৫০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। ডোম-ইনোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুস সালামের বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিনি তার ভাই আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক এবং কুমিল্লা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সবুরের প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন প্রতারণা চালিয়ে গেছেন। তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ পাচার করেছেন বিদেশে।

ভুক্তভোগীদের দুঃসহ অভিজ্ঞতা

ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ সাব্বির হোসেন ২০১৩ সালে আরামবাগে ডোম-ইনোর ‘ইম্পেরিকো প্রজেক্ট’ থেকে দুটি ফ্ল্যাট বুকিং দেন। ২০১৬ সালে হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি থাকলেও ২০২৫ সালেও কাজের অগ্রগতি মাত্র ৫ শতাংশ। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে ৫০ শতাংশ টাকা নিয়েও এখনো ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়নি। আমরা এখন হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছি।’

আরও পড়ুনফ্ল্যাট কিনেও বুঝে পাচ্ছেন না ডোম-ইনোর ক্রেতারাদুর্দিন কাটছে না আবাসন ব্যবসায়ীদের‘ফার’ ইস্যুতে আবাসন ব্যবসায় স্থবিরতাঅলস পড়ে আছে বহু বাণিজ্যিক স্পেস, খেলাপি ঋণ বাড়ার শঙ্কাআবাসন ব্যবসায় ধস, বেড়েছে পুরোনো ফ্ল্যাটের কদর

নয়াপল্টনের রাজকুমার, ২০১৪ সালে ‘ডোম-ইনো ইমপ্লিসিটো’ প্রকল্পে ৭৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেও আজ পর্যন্ত কোনো ফ্ল্যাট বুঝে পাননি। প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ।

রনজিৎ পাল, বসুন্ধরা এলাকায় ফ্ল্যাটের সম্পূর্ণ মূল্য ব্যাংকঋণ নিয়ে পরিশোধ করলেও ১৩ বছরেও ফ্ল্যাট বুঝে পাননি। ভূমি মালিক একেএম জাহাঙ্গীর খান জানান, ২০০৮ সালে যৌথ উন্নয়ন চুক্তি সই করার পর আজও তার ভবনের কাজ শেষ হয়নি।

রিহ্যাব সূত্র জানায়, ডোম-ইনোর অধীনে থাকা তিনটি অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সদস্য। এর মধ্যে রয়েছে- ডোম-ইনো প্রপার্টিজ লিমিটেড, ডোম-ইনো কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এবং ডোম-ইনো বিল্ডার্স। তবে নানা প্রতারণা ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে এই তিন প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ স্থগিত করেছে রিহ্যাব। এছাড়া আরও তিনটি অঘোষিত প্রতিষ্ঠানও পরিচালনা করতেন এমডি আবদুস সালাম, যেগুলো রিহ্যাবের সদস্য ছিল না।

রিহ্যাবের পুরো বোর্ড এই অভিযোগগুলো নিয়ে বৈঠক করেছে। প্রতারণার শিকার অনেকেই মামলা করেছেন, যেগুলো রায়ের ওপর সব কিছু নির্ভর করছে।- রিহ্যাব পরিচালক ড. হারুন রশিদ

আইনি প্রতিকার ও ভুক্তভোগীদের প্রত্যাশা বিষয়ে অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচার। যেন আদালতের নির্দেশে কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে প্রকৃত ভুক্তভোগীদের পাওনা ফেরত দেওয়া যায়।’

ডোম-ইনোর বিরুদ্ধে এই প্রথমবার কোম্পানি আইন অনুযায়ী উইন্ডিং আপ মামলা হয়েছে, যা ভুক্তভোগীদের জন্য একটি কার্যকর আইনি পদক্ষেপ হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এমডি জেলে, চেয়ারম্যান পলাতক

ডোম-ইনোর চেয়ারম্যান পলাতক। ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কারাগারে। ফলে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে প্রতিষ্ঠানটির কল সেন্টারের নম্বরে (0961...9999) যোগাযোগ করলে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ডেভেলপমেন্ট আপাতত বন্ধ। আমি আপনার নম্বরটি কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়ে রাখছি, পরে যোগাযোগ করা হবে।’

কেন ডেভেলপমেন্ট বন্ধ রয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির ডিজিটাল মার্কেটিং বিভাগের কর্মকর্তা রাশিদুল ইসলাম বলেন, ‘না না, আপাতত বন্ধ আছে, তবে আবার শুরু করার প্রসেসও চলছে। সরাসরি অফিসে এসে কথা বললে বেশি বেটার হয়।’

বনানীর এফ ব্লকের ৭ নম্বর রোডের ১৩ নম্বর হাউজে ডোম-ইনোর অফিসে সরেজমিনে গেলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হলেও তারা কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হননি। পরে একজন সম্ভাব্য ক্রেতা সেজে যোগাযোগ করা হলে তরিকুল ইসলাম নামে একজন ডেপুটি ম্যানেজার বলেন, ‘আপনার নম্বরটি রেখে দিচ্ছি, পরে যোগাযোগ করা হবে।’

এরপর তিনি আর কোনো কথা না বলেই সরে যান। অফিসের দ্বিতীয় তলায় আরও কয়েকজন কর্মকর্তা থাকলেও তারাও কথা বলতে রাজি হননি।

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) পরিচালক ড. হারুন রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডোম-ইনো ক্রেতা ও জমির মালিকদের সঙ্গে যেসব অনিয়ম-প্রতারণা করেছে, তা শুধু তাদের নিজের ক্ষতি করেনি, বরং দেশের পুরো আবাসন খাতের সুনামকে সংকটে ফেলেছে।’

এ আবাসন ব্যবসায়ী বলেন, ‘রিহ্যাবের পুরো বোর্ড এই অভিযোগগুলো নিয়ে বৈঠক করেছে। প্রতারণার শিকার অনেকেই মামলা করেছেন, যেগুলো রায়ের ওপর সব কিছু নির্ভর করছে।’

ইএআর/এএসএ/এমএফএ/এএসএম