অপারেশন কিলোফ্লাইটের ক্যাপ্টেন সাহাবউদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম আর নেই। বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সকাল ৮টার দিকে রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসভবনে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন বীর উত্তম সাহাবুদ্দিন আহমেদ (৭৭)।
মৃত্যুর পরও দেশের কথা ভোলেননি এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। নিজের দেহটিও দান করে গেছেন দেশের চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণার জন্য।
বীর উত্তম সাহাবুদ্দিন আহমেদ ফরিদপুর পৌরসভার ২২ নম্বর ওয়ার্ডের চরকমলাপুর মহল্লার মৃত গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ও লাইলী রশিদ দম্পতির ছেলে ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য হাতে গোনা যে কয়জন বেসামরিক ব্যক্তি ‘বীর উত্তম’ খেতাব পেয়েছেন, তাদেরই একজন ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অপারেশন কিলোফ্লাইটের অন্যতম বৈমানিক ছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.) সাহাবউদ্দিন আহমেদ।
মৃত্যুর পর বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে বিমানবাহিনীর ঘাঁটি বাশার প্যারেড গ্রাউন্ডে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে ক্যাপ্টেন (অব.) সাহাবউদ্দিন আহমেদ বীর উত্তমের মরদেহ আনা হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী রোকেয়া নার্গিস, এক ছেলে ক্যাপ্টেন তাপস আহম্মেদ ও এক মেয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা শিপ্রা আহম্মেদসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সাহাবউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসে (পিআইএ) বৈমানিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর তিনি স্থলযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। হবিগঞ্জের শাহজিবাজারের টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্র বিস্ফোরণের অপারেশনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বেসামরিক পাইলট হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি।
অপারেশন কিলোফ্লাইটের মোট ৮৫টি অপারেশনের মধ্যে ১২টি অপারেশনে ছিলেন ক্যাপ্টেন সাহাবউদ্দিন আহমেদ। তিনি ৬ ডিসেম্বর প্রথম হামলায় অংশ নেন। এদিন ক্যাপ্টেন সাহাবউদ্দিন আহমেদ এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে সিলেট, মৌলভীবাজার, শেরপুর ও সাদিপুরের দুটি ফেরিঘাটে থাকা পাকিস্তানি অবস্থান ধ্বংস করেন।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, একাত্তরের আকাশযুদ্ধের অকুতোভয় যোদ্ধা, ঐতিহাসিক ‘অপারেশন কিলোফ্লাইটের’ সদস্য ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ ছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একজন বৈমানিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে হেলিকপ্টার নিয়ে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর জ্বালানি ডিপোতে এবং অটার দিয়ে চট্টগ্রামে জ্বালানি তেলের আরেক ডিপোতে আক্রমণ করেন বাংলাদেশের বিমান সেনারা। সেই অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল অপারেশন কিলোফ্লাইট। ওই সময় ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং তার সহযোদ্ধারা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত করেছিলেন। তাদের আক্রমণের পর ভারতীয় বিমানবাহিনী বাংলাদেশের প্রধান প্রধান বিমানবন্দরগুলোতে আক্রমণ শুরু করে। সেসময় হেলিকপ্টার দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ৫০টি আক্রমণ পরিচালনা করা হয়েছিল, যার ১২টিতে অংশ নিয়েছিলেন ফরিদপুরের সন্তান ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ।
২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে এসে সাহাবুদ্দিন আহমেদ তার দেহদানের আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। সে অনুযায়ী তার মরদেহটি বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অ্যানাটমি বিভাগে হস্তান্তর করেছেন তার ছেলে ক্যাপ্টেন তাপস আহমেদ। মরদেহ হস্তান্তরকালে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ দিলরুবা জেবা, অ্যানাটমি বিভাগের প্রভাষক পূর্ণচন্দ্র বিশ্বাস, ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকী, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শতাধিক শিক্ষার্থী এই বীরের মরদেহ গ্রহণ করতে ও তার প্রতি শ্রদ্ধা-কৃতজ্ঞতা জানাতে উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ দিলরুবা জেবা বলেন, জাতির এই বীর সন্তানকে নিয়ে ফরিদপুরবাসী গর্বিত। সমাজের মহৎ ব্যক্তিরাই মরণোত্তর দেহ দান করে যান। সাহাবউদ্দিন আহমেদ তাদেরই একজন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। মৃত্যুর পরও তিনি এই দেহদানের মধ্য দিয়ে দেশের প্রতি আরেকটি মহান ব্রত পালন করে গেলেন। এতে শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও অধ্যয়নে অনেক উপকারে আসবে। তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।
এন কে বি নয়ন/এফএ/এএসএম