বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠছে চীন। বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণী বেইজিং, সাংহাই, উহান, গুয়াংজু, শিয়ামেনসহ চীনের বিভিন্ন শহরে পড়াশোনা করছেন। বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসা, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবসায় প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—প্রায় সব ক্ষেত্রেই চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন বিশ্বমানে জায়গা করে নিয়েছে। শিক্ষার মান, আধুনিক গবেষণাগার, বৃত্তির সুযোগ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পরিবেশ চীনকে শিক্ষার্থীদের কাছে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে।
চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে শিক্ষাখাতের সম্পর্ক দৃঢ় করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশও এর বড় উপকারভোগী। প্রতি বছর চীনা সরকারের স্কলারশিপ কাউন্সিল (সিএসসি) এবং চীনা দূতাবাসের উদ্যোগে শতাধিক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পূর্ণ বা আংশিক বৃত্তি পেয়ে চীনে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
চীন সরকার শুধু শিক্ষার সুযোগই নয়, বরং দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতেও কাজ করছে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা চীনে গিয়ে শুধু পড়াশোনাই করছেন না, বরং চীনা সংস্কৃতি, ভাষা ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ পাচ্ছেন।
চীনের সাউথ চায়না ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি/ ছবি: নজরুল ইসলাম
চীনে এখন প্রায় তিন হাজার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ৬০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের শীর্ষ ৫০০’র তালিকায় স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে ত্সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পেকিং বিশ্ববিদ্যালয়, ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়, ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংহাই জিয়াওতং বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা সাধারণত ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স, মেডিসিন, কৃষি, ব্যবসা প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ে পড়ছেন। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদান ক্রমেই বাড়ছে, যা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বড় সুবিধা। এছাড়া উন্নত গবেষণাগার ও আধুনিক ক্যাম্পাস সুবিধার কারণে পড়াশোনার মানও ক্রমেই উন্নত হচ্ছে।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে চীন আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার কারণ হলো কম খরচে বিশ্বমানের শিক্ষালাভের সুযোগ। চীনে একটি স্নাতক কোর্সের বার্ষিক ফি সাধারণত ২০-৫০ হাজার ইউয়ান (প্রায় ২–৫ লাখ টাকা), যা ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় অনেক কম।
বর্তমানে ‘স্টাডি ইন চায়না’ প্রোগ্রামের আওতায় পাঁচ লাখেরও বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী চীনে পড়াশোনা করছেন, যার মধ্যে প্রায় পাঁচ শতাংশই বাংলাদেশি।
চীনে বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থী/ ছবি: নজরুল ইসলাম
শিক্ষাগত অভিজ্ঞতা ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনসাউথ চায়না ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস প্রোগ্রামের সাবেক শিক্ষার্থী মো. নজরুল ইসলামের কাছে জাগোনিউজ জানতে চেয়েছিল, তিনি কেন উচ্চশিক্ষার জন্য চীনকে বেছে নিলেন? বাংলাদেশি এ তরুণ জানান, তার লক্ষ্য ভবিষ্যতে ব্যবসা করা। আর বৈশ্বিক ব্যবসার ক্ষেত্রে চীন একটা বড় বিজনেস হাব। এ কারণেই তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য চীনকে বেছে নিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রোগ্রাম বেছে নেওয়ার সময় কী কী বিষয় আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল- এই প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, যে বিষয়ে পড়লে ভবিষ্যতে ব্যবসায় ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করবে এবং বিশ্বব্যাপী ব্যবসা করতে পারবো, আমি সেটাকেই গুরুত্ব দিয়েছি।
চীনে বসবাস ও শিক্ষার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, চীন সম্পর্কে বলতে গেলে এটি ১০০ শতাংশ নিরাপদ একটা দেশ। জীবনযাপনের মান অনেক ভালো। চীন শিক্ষার্থীদের জন্য যেমন নিরাপদ, তেমনি সবদিক থেকেই হেল্পফুল (সহযোগিতাপরায়ণ)। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিতে থাকলে আবাসন ব্যয় কম হলেও বাইরে কিছুটা ব্যয়বহুল। তবে এটি নির্ভর করে মূলত শহরের ওপর। আমি যেহেতু ব্যবসাকে টার্গেট করেছিলাম, তাই গুয়াংজু বেছে নিয়েছিলাম, যেটা চীনের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়িক এলাকা।
চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের দৃশ্য/ ছবি: নজরুল ইসলাম
পড়াশোনার পরিবেশ কেমন?নজরুল ইসলাম বলেন, কয়েক শব্দে ঠিক বলে বোঝানো যাবে না, এখানকার পড়াশোনার পরিবেশ কত ভালো। যদি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার সঙ্গে তুলনা করি, তবে আনুপাতিক হার দাঁড়াবে ৩/৯৭। এখানে একাডেমি কার্যক্রম যথানিয়মে চলে। প্রতি ক্লাস শেষে ১৫ মিনিটের বিরতি দেয় এবং ক্লাসের ধরন এমন যে, সবচেয়ে অমনোযোগী ছেলেও মনোযোগী হতে বাধ্য হবে। বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে শিক্ষকরা ক্লাসে পাঠদান করেন এবং দুই ঘণ্টার ক্লাসে প্রতি শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন।
বৃত্তির সুযোগ: শিক্ষার খরচ নয়, বিনিয়োগচীনে পড়াশোনার অন্যতম আকর্ষণ হলো বিপুল বৃত্তির সুযোগ। চীনা সরকার, প্রাদেশিক প্রশাসন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি দিয়ে থাকে।
চায়না স্কলারশিপ কাউন্সিলের (সিএসসি) আওতায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি, আবাসন, মাসিক ভাতা ও স্বাস্থ্যবিমাসহ সম্পূর্ণ সহায়তা পান। এছাড়া সিল্ক রোড স্কলারশিপ বেল্ট অ্যান্ড রোড ফেলোশিপ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-নির্ভর স্কলারশিপ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের একাংশ নিজস্ব অর্থায়নে পড়তে গেলেও তুলনামূলকভাবে চীনের টিউশন ফি ও জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক কম হওয়ায় খুব বেশি চাপে পড়তে হয় না। বেইজিং বা সাংহাইয়ের মতো শহরে বসবাসের খরচ যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
নানজিং টেক ইউনিভার্সিটি এবং বিজিএলইউ চায়না লিংক প্রোগ্রামেও বাংলাদেশিদের জন্য পূর্ণ বৃত্তি রয়েছে। এইচএসকে (চাইনিজ ভাষার পরীক্ষা) স্কোর থাকলে আইইএলটিএস ছাড়াই এসব বৃত্তির জন্য আবেদন করা যায়।
চীনে একদল বাংলাদেশি শিক্ষার্থী/ ছবি: নজরুল ইসলাম
জনপ্রিয় প্রোগ্রাম ও বিশ্ববিদ্যালয়বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা মূলত এসটিইএম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত), বিজনেস এবং মেডিসিন প্রোগ্রামে আগ্রহী। চীনের ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স, এমবিএ এবং মেডিসিন কোর্স তাদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়।
চীনের গুয়াংজি প্রদেশের বেইবু গালফ ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজির (সিএসটিআই) সাবেক শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল জাবের জাগোনিউজকে জানান, সেখানকার পড়াশোনার পরিবেশ যথেষ্ট ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্ম সুবিধা অনেক উন্নত, এমনকি ইউরোপীয় অনেক দেশের তুলনায়ও বেশি আরামদায়ক।
তিনি জানান, চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের যোগ্যতাও আন্তর্জাতিক মানের। বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং মেজরের শিক্ষকরা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডা থেকে মাস্টার্স বা পিএইচডি করেছেন। এ কারণে তারা শিক্ষার মান অনেক ভালোভাবে বজায় রাখতে সক্ষম। তবে স্থানীয় কিছু শিক্ষকের ইংরেজি তেমন ভালো না হওয়ায় মাঝে মধ্যে বিষয়বস্তু বোঝা কিছুটা কষ্টকর হয়ে যায়।
অন্যদিকে, চীনের পেকিং, ফুদান ও সাংহাই জিওতং বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল ও আইন বিষয়ের জন্য জনপ্রিয়। বিজিএলইউ চায়না লিংক প্রোগ্রাম আইন ও অর্থনীতিতে ভালো। নানজিং টেক ইউনিভার্সিটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফুল ফান্ডেড সুযোগ দেয়।
প্রধান স্কলারশিপচীনের স্কলারশিপগুলো মূলত সরকারি, লোকাল গভর্নমেন্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়-নির্ভর। এদের মধ্যে সিএসসি সবচেয়ে বড়, যা চীনের ২৭৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য। অন্যান্য প্রোগ্রাম, যেমন- সিল্ক রোড স্কলারশিপ বিআরআইর অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়। কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট স্কলারশিপ চীনা ভাষা এবং সংস্কৃতির ওপর ফোকাস করে। এই প্রোগ্রামগুলো স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি স্তরে উন্মুক্ত। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা টাইপ এ (দূতাবাস-ভিত্তিক) বা টাইপ বি (বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক) আবেদন করতে পারেন।
নিচের টেবিলে কয়েকটি জনপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা দেওয়া হলো, যেখানে স্কলারশিপের ধরন এবং স্তর উল্লেখ করা হয়েছে-
স্কলারশিপ প্রোগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম স্তর (স্নাতক/স্নাতকোত্তর/পিএইচডি) চাইনিজ গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ (সিএসসি) পেকিং ইউনিভার্সিটি, তসিংহুয়া ইউনিভার্সিটি, ফুদান ইউনিভার্সিটি, সাংহাই জিয়াওতং ইউনিভার্সিটি, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, উহান ইউনিভার্সিটি, নানজিং ইউনিভার্সিটি, বেইজিং নরমাল ইউনিভার্সিটি, সান য়াত-সেন ইউনিভার্সিটি, হার্বিন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি স্নাতক/স্নাতকোত্তর/পিএইচডি সিল্ক রোড স্কলারশিপ জিয়ামেন ইউনিভার্সিটি, নানকাই ইউনিভার্সিটি, তিয়ানজিন ইউনিভার্সিটি, টংজি ইউনিভার্সিটি স্নাতক/স্নাতকোত্তর/পিএইচডি (বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে) কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট স্কলারশিপ বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার ইউনিভার্সিটি (বিএলসিইউ), রেনমিন ইউনিভার্সিটি অব চায়না চীনা ভাষা কোর্স/স্নাতকোত্তর লোকাল গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ হোহাই ইউনিভার্সিটি (জিয়াংসু), সিচুয়ান ইউনিভার্সিটি, লানঝো ইউনিভার্সিটি, ইস্ট চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটি | স্নাতকোত্তর/পিএইচডি || গ্রেট ওয়াল স্কলারশিপ | শিয়ান জিয়াওতং ইউনিভার্সিটি, জিলিন ইউনিভার্সিটি, বেইজিং ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, নানজিং টেক ইউনিভার্সিটি স্নাতকোত্তর/পিএইচডিনোট: এর সম্পূর্ণ তালিকা সিএসসি-এর ওয়েবসাইটে (campuschina.org) পাওয়া যায়। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি-মাধ্যমে কোর্স (যেমন কম্পিউটার সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং) পড়তে পারেন।
চীনে বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থী/ ছবি: নজরুল ইসলাম
আর্থিক পরিমাণ এবং কভারেজচীনের চাইনিজ গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ (সিএসসি)-এর বার্ষিক আর্থিক মূল্য স্তরভেদে ৫৯ হাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার ইউয়ান (প্রায় ১০–১৮ লাখ টাকা) পর্যন্ত হয়।
নজরুল ইসলাম বলেন, এ টাইপ হলো ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ। এটি বাংলাদেশ থেকে চীনে আসার যে প্লেনভাড়া, সেটা থেকে শুরু করে পড়াশোনা শেষে আবার বাংলাদেশে যে যাবে, সেই প্লেনভাড়াটাও কাভার করে। এতে শিক্ষার্থীর থাকা ও পড়াশোনা ফ্রি। এছাড়া, প্রতি মাসে একটা অর্থ দেয়, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৬০ হাজার টাকার মতো।
কিন্তু যদি কেউ এই সিএসসি স্কলারশিপ না পায়, তার জন্যেও রয়েছে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি স্কলারশিপ ও প্রাদেশিক স্কলারশিপ, মানে এলাকাভিত্তিক স্কলারশিপ। অর্থাৎ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য চীনে পড়াশোনা প্রায় ‘ফ্রি অব কস্ট’ (বিনামূল্যে)। এমনকি, প্রতি মাসে তারা যে পরিমাণ টাকা দেয়, সেটাও সাধারণত খরচ হয় না। যেমন- যদি কেউ প্রতি মাসে ৬০ হাজার টাকা পায়, তাহলে তার বড়জোর ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক টাকাই বেঁচে যায়। কারণ, চীনে ‘লিভিং কস্ট’ (বসবাসের খরচ) অনেক কম।
নিচের টেবিলে বিস্তারিত আর্থিক পরিমাণ এবং কভারেজ দেখানো হলো-
স্তর মাসিক ভাতা (ইউয়ান/টাকা) কভার করা খরচের বিবরণ বহনের হার (%) স্নাতক ২,৫০০ / ~৩৫,০০০ ইউয়ান টিউশন ফি (২০,০০০-৫০,০০০ ইউয়ান/বছর), ফ্রি ডর্ম (৭০০-১,০০০ ইউয়ান/মাস), স্বাস্থ্য বিমা (৮০০ ইউয়ান/বছর), প্রি-প্যারেটরি চাইনিজ কোর্স (১ বছর ফ্রি), সেটেলমেন্ট ভাতা (১,৫০০ ইউয়ান) ৯৫-১০০% স্নাতকোত্তর ৩,০০০ / ~৪২,০০০ ইউয়ান ওপরোক্ত সব + রাউন্ড-ট্রিপ এয়ার টিকিট (কিছু ক্ষেত্রে), গবেষণা ফান্ড (১০,০০০ ইউয়ান/বছর) ৯৫-১০০% পিএইচডি ৩,৫০০ / ~৪৯,০০০ ইউয়ান ওপরোক্ত সব + অতিরিক্ত গবেষণা সাপোর্ট (২০,০০০ ইউয়ান/বছর), কনফারেন্স ভাতা (১,০০০ ইউয়ান) ৯৫-১০০%নোট: এই কভারেজের ফলে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব খরচ বলতে থাকে শুধু বই, ব্যক্তিগত ভ্রমণ বা অতিরিক্ত খরচ (মাসে ৫০০-১০০০ ইউয়ান)। এগুলোর জন্য আইইএলটিএসের পরিবর্তে এইচএসকে স্কোর দিয়ে আবেদন করা সম্ভব, যা বাংলাদেশিদের জন্য সুবিধাজনক।
যোগ্যতা ও বয়সসীমাঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ভাষা সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আফজাল হোসেন জাগোনিউজকে বলেন, চীনে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে হলে অবশ্যই ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক পাস হতে হবে। তবে আমাদের এখান থেকে অনেকেই স্নাতক-স্নাতকোত্তরের পরেও যায়। চীনে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ চীনা ভাষা শেখা। যদি শিক্ষার্থীরা চীনা ভাষা জানে এবং লেভেল ভালো হয়, যেমন- চার বা পাঁচ, তাহলে তারা স্কলারশিপ পায় সহজে। তাই শিক্ষার্থীদের উচিত পড়াশোনা করে ন্যূনতম এইচএসকে স্কোর চার নিয়ে চীনে যাওয়া। তাহলে এই বেনিফিটগুলো পেতে পারে।
চাইনিজ গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ (সিএসসি)
যোগ্যতা:
বাংলাদেশসহ যেকোনো বিদেশি নাগরিক (চীনা পাসপোর্টধারী নয়) শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ভালো একাডেমিক রেকর্ড (সাধারণত জিপিএ ৩.০ বা তার বেশি) সংশ্লিষ্ট স্তরের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার ক্ষেত্রে আইইএলটিএস/টোফেল বাধ্যতামূলক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব ভাষা দক্ষতার সার্টিফিকেট দিলেও চলে চীনা মাধ্যমে পড়লে এইচএসকে (চাইনিজ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্ট) প্রয়োজনবয়সসীমা:
প্রোগ্রাম সর্বোচ্চ বয়স শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক ২৫ বছর উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি/এ লেভেল সমাপ্ত স্নাতকোত্তর ৩৫ বছর স্নাতক ডিগ্রি সমাপ্ত পিএইচডি ৪০ বছর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সমাপ্তসিল্ক রোড স্কলারশিপ
যোগ্যতা:
বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) দেশগুলোর নাগরিক (বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত) একাডেমিক ফল ভালো (জিপিএ ৩.২ বা তার বেশি হলে সুবিধা) নেতৃত্ব, কমিউনিটি সার্ভিস বা আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় আগ্রহ থাকা শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকারবয়সসীমা:সিএসসি-এর মতোই।
লোকাল গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ
যোগ্যতা:
চীনের নির্দিষ্ট প্রদেশ বা শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে (যেমন তিয়ানজিন, জিয়াংসু, সাংহাই ইত্যাদি) পূর্ববর্তী পর্যায়ে ভালো একাডেমিক ফলাফল (কমপক্ষে জিপিএ ৩.০ বা সমতুল্য) সাধারণত এইচএসকে/আইইএলটিএস প্রমাণপত্র চায়বয়সসীমা:সিএসসি-এর মতোই, তবে কিছু প্রদেশে ৩০–৩৫ বছর পর্যন্ত অনুমোদিত।
কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট স্কলারশিপ বা ইন্টারন্যাশনাল চাইনিজ ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার্স স্কলারশিপ
যোগ্যতা:
চীনা ভাষা ও সংস্কৃতিতে আগ্রহী বিদেশি নাগরিক এইচএসকে লেভেল ৩ বা তার বেশি (ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্সের জন্য) ভবিষ্যতে চীনা ভাষা শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী সুস্থ ও শৃঙ্খলাপরায়ণবয়সসীমা:
ভাষা কোর্স: ১৬–৩৫ বছর শিক্ষক প্রশিক্ষণ মাস্টার্স প্রোগ্রাম: সর্বোচ্চ ৪৫ বছরগ্রেট ওয়াল স্কলারশিপ
যোগ্যতা:
ইউনেসকোর সদস্য দেশগুলোর নাগরিক (বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত) চীনে উচ্চশিক্ষা নিতে ইচ্ছুক যোগ্য শিক্ষার্থী চীনা ভাষায় পড়াশোনার জন্য সাধারণত এইচএসকে প্রয়োজনবয়সসীমা:সিএসসি প্রোগ্রামের মতোই (<৩৫ মাস্টার্স, <৪০ পিএইচডি)।
অতিরিক্ত শর্ত ও টিপস বিবাহিত বা অবিবাহিত—দুই অবস্থাতেই আবেদন করা যায় কোনো অপরাধমূলক রেকর্ড থাকা যাবে না কিছু বিশ্ববিদ্যালয় স্টেটমেন্ট অব পারপাস (এসওপি), ২টি রেকমেন্ডেশন লেটার এবং স্টাডি প্ল্যান (ন্যূনতম ৮০০ শব্দ) চায় শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্ট বাধ্যতামূলক আবেদন প্রক্রিয়াআবেদন অনলাইন-ভিত্তিক এবং সহজ। সিএসসির জন্য campuschina.org বা studyinchina.csc.edu.cn-এ রেজিস্ট্রেশন করুন।
প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট: পাসপোর্ট, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, স্টেটমেন্ট অব পারপাস, রেকমেন্ডেশন লেটার (২টি), এইচএসকে/আইইএলটিএস স্কোর, মেডিকেল সার্টিফিকেট, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স।
ডেডলাইন: সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে আবেদন করতে হয়। এরপর আগস্টে রেজাল্ট দেয়। রেজাল্ট ভালো হলে সেপ্টেম্বরেই চীনে চলে আসা যায়। প্রতি বছর শুধু সেপ্টেম্বর সেশনে শিক্ষার্থীরা এই স্কলারশিপে চীনে আসতে পারে। এর প্রক্রিয়া অনেক সহজ, আইইএলটিএস লাগে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমওআই (মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন) হলেই আবেদন করা যায়। চীন দূতাবাস আবেদনের প্রি-স্ক্রিনিং করে, যা সাফল্যের হার অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।
চীনের ভিসা (এক্স১/এক্স২) পাওয়ার জন্য স্কলারশিপ অফার লেটার প্রয়োজন। বাংলাদেশে বেশ কিছু কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান আবেদন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে থাকে।
চীনে দেশি পোশাকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী/ ছবি: নজরুল ইসলাম
পার্ট-টাইম চাকরিচীনে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পার্ট-টাইম চাকরির সুযোগ আছে, কিন্তু এটি কঠোর নিয়মাবলী এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ২০২২ সাল থেকে চীন সরকার এই সুযোগকে কিছুটা শিথিল করেছে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের অর্থনৈতিক চাপ কমাতে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। তবে, এটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে করা যায় না, এর জন্য অবশ্যই ইউনিভার্সিটির অনুমোদন এবং সরকারি পারমিট দরকার হয়।
বিনাঅনুমতিতে কাজ করলে মোটা অংকের জরিমানা, ভিসা বাতিল বা দেশ থেকে বিতাড়নের ঝুঁকি রয়েছে।
সেমিস্টার চলাকালে সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা (মাসে সর্বোচ্চ ৪০ ঘণ্টা) এবং ছুটির সময় সপ্তাহে ১৬ ঘণ্টা (মাসে সর্বোচ্চ ৮০ ঘণ্টা) কাজ করা যাবে।
চ্যালেঞ্জচীনে পড়াশোনার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো চাইনিজ ভাষার এইচএসকে লেভেল ৪ (চার) পাস করা। আব্দুল্লাহ আল জাবের জানান, কোনো শিক্ষার্থী এই লেভেল পাস না করলে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গ্রাজুয়েট ডিগ্রি সার্টিফিকেট দেবে না।
ভাষা সমস্যা ছাড়াও সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং স্কলারশিপ না পাওয়া গেলে খরচও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে যারা এইচএসকে ৪ পাস করে, তাদের জন্য চাকরির সুযোগ অসাধারণ। চীন বা বাংলাদেশের উভয় ক্ষেত্রেই তারা উচ্চমানের চাকরি পেতে পারে।
পরামর্শ চীনে পড়াশোনার জন্য আগে থেকে চাইনিজ ভাষা শেখা গুরুত্বপূর্ণ। স্কলারশিপ-ভিত্তিক আবেদন করুন। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নেটওয়ার্কিং করুন। আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব ও গবেষণা সুবিধা ব্যবহার করুন। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাবাংলাদেশ সরকার চীনের সঙ্গে শিক্ষা সহযোগিতা জোরদার করছে। দুই দেশের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যৌথ গবেষণা, এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ও অনলাইন শিক্ষায় সহযোগিতা বাড়ছে। উহান বিশ্ববিদ্যালয়, দালিয়ান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, এবং ইউনান বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা সমঝোতা করেছে। কৃষি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জলবায়ু পরিবর্তন ও তথ্যপ্রযুক্তি—এই চারটি খাতে যৌথ গবেষণায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ভাষা সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আফজাল হোসেন বলেন, বর্তমানে চীনের প্রতি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রচুর আগ্রহ রয়েছে। কারণ চীন গন্তব্য হিসেবে খুবই ভালো। চীনা সরকার অনেক বেশিসংখ্যক স্কলারশিপ দেয়, টাকা-পয়সা যা দেয় তাতে ভালোই চলে। আর একটা বিষয় হচ্ছে, কসঙ্গে দুইটা স্কিল ডেভেলপ করে। একটা হচ্ছে- সে একটা ডিগ্রি পাচ্ছে। আরেকটা হচ্ছে- চীনা ভাষা শিখলে চীন হোক, বাংলাদেশ হোক বা অস্ট্রেলিয়া-কানাডা, চীনা ভাষার অনেক চাহিদা রয়েছে। সে কারণে অনেক শিক্ষার্থীর সেদিকে ঝোঁক বাড়ছে।
এছাড়া চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো (যেমন- হুয়াওয়ে ও আলিবাবা) বাংলাদেশের তরুণদের প্রশিক্ষণের সুযোগ দিচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী চীনে পড়াশোনা শেষে এসব প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ কিংবা চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন।
নজরুল ইসলাম বলেন, চীনে পড়াশোনা করলে চাকরির অভাব নেই, এখানে প্রচুর চাকরি। বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে বেতন স্কেলও কয়েকগুণ বেশি। এখানে পড়াশোনা করে কেউ যদি চীনা ভাষাটা শিখতে পারে, তাহলে তাকে চাকরির জন্য একদিনও বসে থাকা লাগে না। তার উদাহরণ আমি নিজেই। আমি যেদিন ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তার পরেরদিনই একটা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হই।
সুতরাং, চীনের উচ্চশিক্ষা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এক বিশাল সুযোগ, যা তাদের শিক্ষাগত এবং পেশাগত উভয় ক্ষেত্রেই এগিয়ে নেবে। সঠিক পরিকল্পনা, প্রস্তুতি এবং ভাষা দক্ষতার মাধ্যমে এই স্বপ্ন সত্যি করা সম্ভব।
তথ্যসূত্র: স্টাডি ইন চায়না, অ্যাপ্লাই ফর চায়না, ক্যাম্পাস চায়না, চীনা দূতাবাসকেএএ/