সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলেও বর্তমান সাংবিধানিক বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। ফলে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ ব্যবস্থার মাধ্যমে করা যাবে না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন করতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে বুধবার (২২ অক্টোবর) প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চে দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে আপিলকারী আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া এ কথা জানান।
শুনানিতে এ বিষয়ে আপিল বিভাগের কাছে একটি দিকনির্দেশনাও চান এ আইনজীবী।
শুনানিতে শরীফ ভূঁইয়া বলেন, বিচার বিভাগের যেভাবে কাজ করার কথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংক্রান্ত মামলার রায় দিতে গিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ সেভাবে কাজ করেননি। তারা বিচারিক ক্ষমতার বহির্ভূত কাজ করেছেন।
তিনি বলেন, আপিল বিভাগ এ রায় দিতে গিয়ে বাংলাদেশের সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের কাজও করে ফেলেছেন। তারা ক্ষমতার বাইরে গিয়ে বা এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, যার ফলে এটি রায়ের একটি ভুল দিক।
ওইদিন শুনানিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও রুহুল কুদ্দুস কাজল। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
এর আগে গত মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) প্রথম দিনের মতো শুনানি হয়। গতকাল বুধবার শুনানির পর এ মামলার কার্যক্রম মুলতবি করেন আদালত।
আরও পড়ুনতত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলে সংসদের ক্ষমতা খর্ব করবে কি না: প্রধান বিচারপতিতত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরলে কবে থেকে কার্যকর হবে?
আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া বলেন, আদালতের রায়ের মাধ্যমে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হলেও বর্তমান সাংবিধানিক বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেই আগামী জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর নতুন সরকার গঠিত হবে। সেই সংসদ ভেঙে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা যাবে। ফলে আসন্ন ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না।
‘কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা করার যে বিধান ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, সংবিধানের এ সংক্রান্ত বিধান মতে, সংসদ ভেঙে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করতে হলে এবং ওইরকম একটি সরকার গঠন করতে হলে এটি শুধু সংসদ ভেঙে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে করা সম্ভব।’
শরীর ভূঁইয়া বলেন, আমাদের সংসদ কিন্তু এক বছরেরও আগে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কাজেই এ বিধান এখানে প্রযোজ্য নয়। গত এক বছর আগে এ সময় পার হয়ে গেছে। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরলেও এখন আর একটি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী গঠন করার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারই আগামী নির্বাচন সম্পন্ন করবে। বর্তমান সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, আগামী নির্বাচন করার দায়িত্ব তারা তখনই পেয়েছে। সরকার চাইলেও এখন নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে পারবে না, কারণ এটি সংসদ ভেঙে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে করতে হয়। সেই সময় আমরা বহু আগে পার হয়ে এসেছি।
শরীফ ভূঁইয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় হয়তো কিছু ভুল-ত্রুটি আছে বা সেটিকে আরও ইমপ্রুভ করা সম্ভব। বিগত ১/১১ সরকারের সময়কার অভিজ্ঞতার আলোকে অনেকে বলার চেষ্টা করেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে দেশে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত সরকার এসেছিল। তবে এটি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কোনো ত্রুটির কারণে নয়, বরং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সংবিধান লঙ্ঘন করে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন, এটি তারই ফল।
‘কাজেই এ সংকট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ত্রুটির কারণে নয়, বরং তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সংবিধান লঙ্ঘনের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। এ ত্রুটি-বিচ্যুতির ব্যাপারে আদালত কোনো পর্যবেক্ষণ দিতে পারে। আদালতের এখতিয়ার হলো কোনো আইন বা সংবিধান সংশোধন; এটি সঠিক কি না, তা দেখা। এ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। আর আইনকে ইমপ্রুভ করার দায়িত্ব লেজিসলেচারের। এ দায়িত্ব বিচার বিভাগ নিতে পারে না।’
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ, বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে একটি ভিন্ন সাংবিধানিক ব্যবস্থায়, এটি কিন্তু সংবিধানের কোনো লিখিত অনুচ্ছেদের অধীনে গঠিত হয়নি। বিপ্লব পরবর্তী জনগণের আকাঙ্ক্ষা স্বরূপ, দেশের সরকার পালিয়ে যাওয়ার ফলে তৈরি হওয়া শূন্যতা এবং দেশে একটি সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে এ সরকার গঠিত হয়েছে।
‘এ সরকারকে জনগণ কয়েকটি জিনিসের ম্যান্ডেট দিয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো দেশ পরিচালনা করা। তারপর হলো বিপ্লব পরবর্তী আকাঙ্ক্ষাকে রূপায়ন করার জন্য সংস্কার করা। সবশেষে একটি নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া। কাজেই এ সরকার সেভাবেই তার ক্ষমতা হস্তান্তর করে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবে।’
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই বছরের ২৭ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে প্রথম আবেদন করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি। অন্যরা হলেন–তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান।
একই বছরের ১৬ অক্টোবর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। এর এক সপ্তাহ পর ২৩ অক্টোবর রিভিউ আবেদন করেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
১৯৯৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। তবে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট রুল জারি করেন।
আরও পড়ুনদলীয় লোক সরিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি বিএনপির
২০০৪ সালের ৪ আগস্ট চূড়ান্ত শুনানি শেষে রিটটি খারিজ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করা হয়। আদালত এ মামলায় আট জন অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ করে তাদের মতামত শোনেন। তাদের মধ্যে পাঁচ জন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে মত দেন।
তারা হলেন–ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। অপর অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মতো দেন।
ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ড. এম জহির তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পক্ষে মত দিয়ে তাদের প্রস্তাব আদালতে তুলে ধরেন। এছাড়া তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দেন।
২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং ৩ জুলাই গেজেট প্রকাশিত হয়। এরপর টানা তিনটি জাতীয় নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) দলীয় সরকারের (আওয়ামী লীগের) অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।
এফএইচ/এমকেআর/এএসএম