‘সরকারের পক্ষ থেকে চার্ট টানিয়ে দিয়ে গেছে ২২ টাকা দরে। আর বিক্রি হচ্ছে ৮-৯ টাকা। এবার আমার কোটি টাকা লোকসান হবে। ঋণের চাপে কথা বলতে পারছি না। আলুর দাম বাড়লেই সাংবাদিক, ভোক্তা অধিকার, প্রশাসন এসে হাজির হয়। এখন কাউকে দেখি না।’
আলুর দাম নিয়ে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুন্সিগঞ্জের আলু ব্যবসায়ী রশরাজ। তবে শুধু এই ব্যবসায়ী না, আলুর দাম পড়ে যাওয়ায় লাখ লাখ টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন অনেক ব্যবসায়ী। তারা বলছেন, হিমাগার খরচ, লেবার খরচ ও উৎপাদন খরচ বাদ দিলে লাভতো দূরের কথা, কেজিতে লোকসান হচ্ছে ১৬-১৮ টাকা।
দেশের শীর্ষ আলু উৎপাদনকারী অঞ্চল মুন্সিগঞ্জ। উৎপাদিত আলু শুধু স্থানীয় চাহিদাই মেটায় না, বরং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা এখান থেকে আলু কিনে নিয়ে যান। তবে এবার আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় আলুচাষি ও ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিকেজি আলুর পাইকারি মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে ২২ টাকা। তবে এ দামে আলু কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না খুচরা বিক্রেতারা।
হিমাগার সূত্রে জানা যায়, ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ডাইমন্ড আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকা আর স্টিক (লাল) আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা। এরমধ্যে হিমাগার খরচই ৩০০ টাকা। লেবার খরচ ১০ টাকা। ফলে এক বস্তা আলু বিক্রি করে ১০০ টাকাও হাতে থাকছে না। ফলে আলু চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা।
বর্তমানে পাইকারি প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৮-৯ টাকা দরে। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৪-১৫ টাকা দরে। কৃষকরা বলছেন, কেজিতে তাদের ১৬-১৮ টাকা লোকসান হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ছয়টি উপজেলায় ৩৪ হাজার ৭৫৮ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়। এবার উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৮২ মেট্রিক টন আলু। গতবছর উৎপাদন হয়েছিল ১০ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন।
আলু সংরক্ষণে জেলার ৭৪টি হিমাগারের মধ্যে সচল রয়েছে ৫৮টি। সচল থাকা এসব হিমাগারের আলু সংরক্ষণের ধারণক্ষমতা রয়েছে ৫ লাখ মেট্রিক টন। এতে এ জেলায় উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি তথা পাঁচ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টনের মতো আলু সংরক্ষণের বাইরে থেকে যাচ্ছে। হিমাগারে সংরক্ষণ করতে না পেরে ওই আলু কৃষক তার বাড়িতে মাচায় সংরক্ষন করছেন। দীর্ঘদিন মাচাবন্দি থাকায় পচে নষ্ট হচ্ছে এসব আলু।
আরও পড়ুন: হিমাগারের আলু নিয়ে বিপাকে কৃষক-ব্যবসায়ীআলু বীজের দাম সর্বনিম্ন হলেও সারের দাম বেশিঘোষণা দিয়েও আলু কেনেনি সরকার, পড়তি দামে লোকসানে কৃষকআলুর সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দিলো সরকারসরকারি মূল্য নির্ধারণের দাবিতে নওগাঁয় সড়কে আলু ফেলে বিক্ষোভ
কৃষক ও ব্যবসায়ীরা পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৫ মেট্রিক টন আলু হিমায়িত করেন। যার মধ্যে তিন লাখ ৪১ হাজার ৭০ মেট্রিক টন খাওয়ার আলু। বাকি এক লাখ ৬ হাজার ১৬১ মেট্রিক টন বীজ আলু রয়েছে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর এককেজি আলু উৎপাদনে ১৬-১৮ টাকা খরচ পড়েছে তাদের। আর হিমাগার পর্যন্ত আলু নেওয়ার জন্য পরিবহন ও শ্রমিকের পারিশ্রমিকের সঙ্গে হিামাগার ভাড়া যোগ করলে তা দাঁড়াবে ২৬-২৮ টাকায়। গতবছর হিমাগারে আলু সংরক্ষণে ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি ভাড়া পড়তো ২১০-২৫০ টাকা। এবছর সেই বস্তার ভাড়া পড়ছে ৩০০ টাকা করে। সবমিলিয়ে কেজিতে লাভতো দূরে থাক, লোকসান হচ্ছে ১৮-২০ টাকা।
জেলা সদরের বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস কোল্ডস্টোরের আলু মজুত ব্যবসায়ী হারুন-অর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার আমি হিমাগারে ৩২ লাখ টাকার আলু মজুত করেছি। প্রথম দিকে ৯ লাখ টাকার বিক্রি করেছি। এরপর আর আলু কেউ নিচ্ছে না। কেউ নিলেও যে দাম বর্তমান বাজারে তাতে পকেটে এক টাকাও আসছে না। এতে আমার ২৩ লাখ টাকা লোকসান হবে।’
বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস হিমাগারের ব্যবস্থাপক আবদুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কৃষক ও ব্যবসায়ীদের অবস্থা খারাপ। তাদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বর্তমান বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকা বস্তা। এরমধ্যে হিমাগার খরচ ৩০০ টাকা, লেবার খরচ ১০ টাকা, আনুষঙ্গিক আরও কিছু খরচ রয়েছে। এতে প্রায় ৩৩০ টাকার মতো খরচ পড়ে যাচ্ছে। কৃষক পাচ্ছে বস্তাপ্রতি ৭০ টাকা থেকে ১০০ টাকা।’
একইভাবে লোকসানের কথা বললেন এলাইড হিমাগারের ব্যবসায়ী মো. দুলাল। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কৃষকের কাছ থেকে বস্তাপ্রতি ৮০০-৯০০ টাকা দরে আলু কিনেছি। হিমাগার ভাড়া ৩০০ টাকা, লেবার খরচ ১০ টাকা। বস্তায় ঘাটতি আছে ২-৩ কেজি। আর বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা বস্তা। হিমাগারের ভাড়া ও লেবার খরচ দিয়ে হাতে টাকা পাচ্ছি ৯০ টাকা। এবার লোকসানের হিসেবটা আপনারাই করে দেখেন।’
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাস জাগো নিউজকে বলেন, এবার চাহিদার তুলনায় বেশি আলু উৎপাদন হওয়ায় সারাদেশেই আলুর দামে প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, খরচ কমিয়ে কৃষকরা যাতে লাভবান হতে পারেন, সেজন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। তাদের যে গতানুগতিক ধারা রয়েছে সে ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যে আলু রপ্তানি করা যায়, সেই জাতের আলু আবাদ করতে হবে। রপ্তানি উপযোগী যে জাত রয়েছে, ওইগুলো আবাদ করলে কৃষক লাভবান হবে।
মজুত আলু প্রসঙ্গে অতিরিক্ত উপ-পরিচালক বলেন, ‘বর্তমানে হিমাগারগুলোতে প্রচুর পরিমাণ আলু মজুত রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলেছি, যাতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় এনে এগুলো বিতরণ করা যায়।’
এসআর/এএসএম