ফিচার

শেয়াই পিঠা বাগেরহাটের শীতকালীন ঐতিহ্য

রাত নামলেই শীতল বাতাস আর ভোরের শিশির বিন্দু জানান দিচ্ছে শীত আসতে শুরু করেছে। চলে এসেছে উৎসবের মৌসুম। এ সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম জেলা বাগেরহাটের গ্রাম থেকে শহরে ঘরে ঘরে বানানো হয় শীতের পিঠা। ভাপা, পাটিসাপটা, চিতই, নকশি, পুলি কত নামের আর হরেক রকম স্বাদের এসব পিঠা। তবে সময়ের সাথে সাথে ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে এ অঞ্চলের শেয়াই পিঠা। শীতকালে বাগেরহাট-খুলনায় অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে পারিবারিক আয়োজনে শেয়াই পিঠা হয়ে ওঠে উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

শেয়াই পিঠা অঞ্চলভেদে সেমাই পিঠা, শিয়েই পিঠা বা শিয়াই পিঠা নামেও পরিচিত। পিঠা তৈরি করতে দুই-তিন জন মানুষের প্রয়োজন। প্রথমে চালের গুঁড়া হালকা ফোটানো পানিতে সেদ্ধ করে মণ্ড বা কাই তৈরি করে নিতে হয়। রুটি বানাতে যেমন মণ্ড বা কাই তৈরি করা হয়। পরে ঠান্ডা হলে ছোট গোল গোল বলের আকার করে নিতে হয়। এরপর পিতল বা কাঠের মেশিনে দিয়ে হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তৈরি করতে হয় এ পিঠা।

বানানোর পর অল্প অল্প করে গরম পানির ভাপে ভাপা পিঠার মত সেদ্ধ করতে হয়। এ পিঠা দেখতে অনেকটা নুডলসের মতো। ভাতের বিকল্প হিসেবে দুপুর ও রাতের খাবারে শেয়াই পিঠা খেয়ে থাকেন খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলের মানুষ। যে কোনো মাংসের সাথে খাওয়া যায় এ পিঠা। তবে চুইঝাল দিয়ে রান্না হাঁসের মাংসের সাথে এর স্বাদ অতুলনীয়।

সম্প্রতি বিয়ে করেছেন জেলা শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার রিয়াজুল ইসলাম। আবাসিক হোটেলে কর্মরত রিয়াজুলের কথায় উঠে আসে উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই মিলে পিঠা বানানোর কথা। তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন বেড়াতে এলে শেয়াই পিঠা বানিয়ে খাইয়েছি। বাবা-মা, ভাই-ভাবি, শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালিকা সবাইকে নিয়ে আয়োজন করে বানিয়েছি। একজন চালের গুঁড়া সেদ্ধ করেছেন, একজন মণ্ড বানিয়ে গোল গোল করেছেন, আমি মেশিন ঘুরিয়েছি, একজন পিঠা সেদ্ধ করেছেন, একজন মাংস রান্না করেছেন। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। পরিবারের সবাই মিলে পিঠা বানানো, গল্প আর হাসি-ঠাট্টায় মুখর থাকে পুরো বাড়ি।’

আরও পড়ুনহেমন্তের ছোঁয়ায় প্রাণ ফিরে পেল বুড়িগঙ্গাঘোড়া চালানো শিখতে পারবেন ঢাকার ৩০০ ফিটে

তবে এ সময়ের আনন্দ আগের তুলনায় কিছুই নয় বলে দাবি ষাটোর্ধ্ব সায়েরা বেগমের। তিনি বলেন, ‘এখনকার ছেলে-মেয়েরা পিঠা উৎসব যা দেখে, তা সামান্য। আগে শীত আসার আগেই পুরো গ্রাম জমে উঠতো। আমন ধান কাটা শেষ হলেই নবান্ন আর পিঠা-পুলির ধুম পড়তো। চারদিকে ঢেঁকির আওয়াজ শুনলেই মনটা ভরে যেত। আমরা দলবেঁধে ঢেঁকিতে ধান ভানতাম, কেউ গান ধরতো। বাহারি পিঠা, ফিরনি-পায়েস আর ক্ষীর তৈরির সমারোহ। বেশিরভাগ বাড়িতে চলতো শেয়াই পিঠার উৎসব। শেয়াই পিঠা বানিয়ে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই মিলে খেতাম। এখনও পিঠা উৎসব হয়। তবে আগের সেই আনন্দ-উৎসব হারায়ে গেছে।’

সাতক্ষীরা থেকে বাগেরহাট পিসি কলেজ পড়তে আসা ফাহিম ফয়সাল বলেন, ‘বাগেরহাট পড়তে আসার পর হঠাৎ একদিন বাসার মালিক নুডলসের মতো পিঠা আর সাথে মাংস দিলেন। খেয়ে দেখি খুবই সুস্বাদু। এমন সুস্বাদু একটা পিঠা অথচ এলাকায় থাকতে নাম শুনিনি। এখন মাঝে মধ্যে বাইরের হোটেল থেকে কিনে খাই। ভাবছি বাসায় শেয়াই পিঠা বানানোর মেশিন কিনে নিয়ে যাবো।’

শেয়াই পিঠাকে কেন্দ্র করে শহরের নূর মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড, দশানীসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠছে পিঠা ঘর। একই সাথে বাসায় তৈরি করে বিক্রিও করছেন অনেকে। তেমনই একজন সরুই এলাকার মারিয়া মুন। সম্প্রতি স্নাতক শেষ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এ পিঠা আমাদের ঐতিহ্য। ব্যস্ততার কারণে সবাই বাসায় তৈরি করতে পারেন না। ঘরে অলস বসে না থেকে দুই বছর ধরে আমি পিঠা তৈরি করে বিক্রি করি। ছোট বোন আমাকে সহায়তা করে। মোটামুটি হাতখরচের টাকা হয়ে যায়। আরও কিছু শখ পূরণ করতে পারি।’

শীত এলে বিক্রি বাড়ে পিঠা তৈরির মেশিনেরও। বাগেরহাটের প্রধান বাজারের একজন পিঠার কল বিক্রেতা সালাম শেখ বলেন, ‘সারাবছর টুকটাক বেচাকেনা হয়। তবে শীত এলে আমাদের বিক্রি বেড়ে যায়। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ কল কিনতে আসে। পিতলের তৈরি পিঠার কলের দাম প্রকারভেদে ৯০০ থেকে ২৫০০ টাকা এবং কাঠের তৈরি কলের দাম ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা।’

গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সুস্বাদু এই পিঠা ব্র্যান্ডিং করতে পারলে দেশ-বিদেশে পরিচিত হয়ে উঠবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

নাহিদ ফরাজী/এসইউ/এএসএম