হেমন্তের ছোঁয়ায় প্রাণ ফিরে পেল বুড়িগঙ্গা
ঢাকার ভেতর বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা একসময় ছিল শহরের প্রাণ, জীবনের প্রবাহ। কিন্তু সময়ের নির্মমতায়, দূষণের ভারে, মানুষের অবহেলায় এই নদী হয়ে উঠেছিল এক নিঃশ্বাসহীন জলরাশি। কালো পানিতে জমে থাকা আবর্জনা, দুর্গন্ধ ও প্রাণহীন স্রোত যেন শহরের কোলাহলের মতোই ক্লান্ত আর ভারাক্রান্ত। ছবিগুলো তুলেছেন বিপ্লব দীক্ষিৎ।

তবু প্রকৃতি কখনও হারে না। প্রতি বছর বর্ষা ফিরে আসে নতুন আশার আলো নিয়ে। মেঘভেজা বাতাসে, টুপটাপ বৃষ্টির ছন্দে যখন ঢাকার রাস্তাঘাট ভিজে ওঠে, তখন ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পেতে থাকে বুড়িগঙ্গাও। বর্ষা চলে গেলেও হেমন্তে সেই ঐশ্বর্য যেন অটুট থাকে।

হঠাৎ বৃষ্টি নামলেই নদীর চেহারা পাল্টে যায়। কালো মলিন পানি ধুয়ে যায় বৃষ্টির ধারা ও দূরবর্তী পাহাড়ের স্রোতের সঙ্গে মিশে আসা স্বচ্ছ জলে।

হঠাৎই যেন বুড়িগঙ্গার বুকে জেগে ওঠে এক জীবন্ত সৌন্দর্য। সূর্যের আলো পড়লে সেই স্বচ্ছ জলে দেখা যায় মাছের দৌড়ঝাঁপ, ঢেউয়ের সঙ্গে নাচানাচি করা ছোট ছোট নৌকা, আর সেই সঙ্গে মানুষের মুখে ফিরে আসে হাসি।

সদরঘাটের আশেপাশে তখন অন্যরকম এক প্রাণচাঞ্চল্য। সারাদিনের ক্লান্ত যাত্রীরা নদী পারাপারের পথে হালকা বাতাসে পানির গন্ধ পায়, যা আজ আর দুর্গন্ধ নয় বরং জীবনের ঘ্রাণ।

নৌকার মাঝিরা তখন মনের আনন্দে গেয়ে ওঠে, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোরে চিনি না ভাই, তোরে চিনি না…’ তাদের কণ্ঠে বাজে এক নির্ভেজাল সুখের সুর, যেটা বয়ে আসে নদীর বুক দিয়ে।

নৌকাগুলোর সারি, পানির ওপর ভাসমান আলোর প্রতিফলন, আর দূরের আকাশে ভেসে থাকা মেঘ-সব মিলিয়ে যেন এক চিরচেনা অথচ নতুন বুড়িগঙ্গা। এই নদী শুধু জল নয়, এটি শহরের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত ইতিহাস, স্মৃতি আর টিকে থাকার গল্প।

বর্ষা থেকে হেমন্ত যেন তাকে প্রতি বছর নতুন করে জন্ম দেয়। যেমন কোনো ক্লান্ত মানুষ এক ঝড়বৃষ্টির রাতে নিজের ভেতর খুঁজে পায় নতুন প্রাণ, ঠিক তেমনি বুড়িগঙ্গাও বৃষ্টির স্পর্শে ফিরে পায় তার হারানো যৌবন।

দূষণ আর অবহেলায় যে নদীকে আমরা প্রায় মেরে ফেলেছিলাম, সেই নদীই আজ আবার প্রাণের বার্তা দেয়। তার জলে মাছের খেলা, তার ঢেউয়ে আলোছায়ার নাচ-এসব যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রকৃতিকে ভালোবাসলে সে-ও ভালোবাসতে জানে।

বৃষ্টিভেজা বিকেলে সদরঘাটে দাঁড়িয়ে যখন কেউ দেখে বুড়িগঙ্গার বুক জুড়ে ভেসে চলা নৌকাগুলো, তখন মনে হয়, এই শহর যতই কংক্রিটে মোড়া হোক না কেন, তার হৃদয়ে এখনো একটা নদী বেঁচে আছে। যে নদী ভালোবাসে, গান গায়, বর্ষা আর হেমন্তের ছোঁয়ায় আবারও নতুন করে বাঁচতে শেখায়।
জেএস/