ভালোবাসার শহর প্যারিস। শহরটির প্রতিটি কোণে যেন রোমান্সে ভরা। সিন নদীর তীরে হাতে হাত রেখে হাঁটা, আইফেল টাওয়ারের আলোয় একে অপরের মুখ দেখা কিংবা পাহাড়চূড়ায় পুরো প্যারিসকে দেখা। আর এই শহরের মঁমার্ত্র পাহাড়েই রয়েছে ভালোবাসার আরেক নিদর্শন- ভালোবাসার তালা।
হালকা ঠান্ডা বাতাসে মঁমার্ত্র পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতেই দেখা মেলে সাদা গম্বুজওয়ালা সেই বিখ্যাত গির্জা- সাঁক্রে-ক্যর ব্যাসিলিকা। পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে, যেন মেঘের কোল ঘেঁষে। দূর থেকে পুরো প্যারিস দেখা যায়- এক রূপকথার শহর।
গির্জার সামনে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল এক অদ্ভুত দৃশ্য- লোহার রেলিংজুড়ে ঝুলছে শত শত তালা! কারও লাল, কারও রূপালি, আবার কেউ নিজ হাতে রঙ করেছে নিজের নাম দিয়ে।
পাশে দাঁড়িয়ে এক তরুণ দম্পতি তালা লাগিয়ে হাসছে। জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি হেসে বলল, ‘এখানে তালা লাগিয়ে চাবিটা ফেলে দিলেই ভালোবাসা চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যায়’ এটাই প্যারিসের প্রতিশ্রুতি।
তাদের সেই হাসিতে যেন ভালোবাসার শহরের আত্মাটাই ধরা পড়লো। সাঁক্রে-ক্যর গির্জার চারপাশে শুধু তালা নয়, আছে গল্পের ছায়া। কেউ এসেছে নববিবাহিত হয়ে, কেউ এসেছে সম্পর্কের নতুন শুরুতে।
দু’জন মিলে নাম লেখা একটি তালা ঝুলিয়ে দেয়, তারপর চাবিটি ছুড়ে দেয় দূরে- সিন নদীর দিকে কিংবা নিচের শহরের দিকে। তাদের বিশ্বাস, ‘যেমন তালা খোলার উপায় থাকে না, তেমনি এই ভালোবাসাও কখনও ভাঙবে না।’
এই রীতিটিই আজ প্যারিসের প্রেমিকযুগলদের এক চিরন্তন ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভালোবাসার শহরের তালার ঠিকানাগুলো প্যারিসে এই ‘লাভ লক’ বা ভালোবাসার তালার সংস্কৃতি শুধু পাহাড়চূড়ায় সীমাবদ্ধ নয়, ছড়িয়ে আছে গোটা শহরজুড়ে।
সিন নদীর ওপর অবস্থিত এই সেতুটিতেই শুরু হয়েছিল প্যারিসের ‘লাভ লক’ ঐতিহ্য। একসময় হাজার হাজার তালায় ভরে গিয়েছিল রেলিং, যার ওজনে সেতু দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পরে কর্তৃপক্ষ অনেক তালা সরিয়ে ফেললেও এখানেই শুরু হয়েছিল ভালোবাসার গল্পের বন্ধন।
সিন নদীর সবচেয়ে পুরোনো সেতুগুলোর একটি। এখানেও এখনো অনেক যুগল গোপনে তালা লাগিয়ে যায়, ভালোবাসার নিঃশব্দ প্রতীক হিসেবে।
আইফেল টাওয়ারের নিচের রেলিং ও ভিউ পয়েন্টে– পর্যটকরা এখানে এসে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে তালা লাগায়। কেউ নাম লেখে, কেউ শুধু একটি হৃদয়ের চিহ্ন এঁকে রাখে স্মৃতির সীমানায়।
মনটামার্টে হিল ও স্কয়ার সেয়ার বালিসা এলাকায় পাহাড়চূড়ার রেলিং, গির্জার সিঁড়ি ও আশপাশের দেয়ালজুড়ে ঝুলে থাকে ছোট ছোট তালা। কিছুতে লেখা ‘লাভ ফরইভার’, কিছুতে শুধুই তারিখ—যেদিন তারা একে অপরের হাত ধরেছিল।
বিকেলের আলো যখন গির্জার সাদা গম্বুজে পড়ে, তখন সেটি যেন সোনালী হয়ে ওঠে। পাহাড়ের নিচে ছড়িয়ে থাকা প্যারিসের ঘরবাড়ি, রাস্তা আর দূরে দেখা যায় আইফেল টাওয়ারের ঝলমলে মাথা। সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এই শহর শুধু ইতিহাসের নয়- এটি আবেগের, ভালোবাসার।
তালা ঝুলছে, বাতাস বইছে, কেউ ছবি তুলছে, কেউ প্রার্থনা করছে—সবকিছুর মধ্যেই এক মায়াবী প্রশান্তি। চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে কফির গন্ধ আর স্যাক্সোফোনের সুর। এ যেন এক শহর, যেখানে প্রতিটি নিঃশ্বাসে প্রেমের ছোঁয়া।
ভালোবাসা হয়তো দেখা যায় না, কিন্তু প্যারিসে সেটি অনুভব করা যায়- তালার ধাতব শব্দে, গির্জার সিঁড়িতে বসা হাসিমুখে, আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো রোমান্সের সুবাসে।
এমআরএম