মাজহারুল আলম তিতুমির
বাড়ির সাথে বড় বড় পুকুর, আশেপাশে ধান ও সবজি চাষের জমি, খানিকটা দূরে খালের উপস্থিতিতে সবুজ সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে আমরা বেড়ে উঠেছি। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে সেই খাল মিলেছে কর্ণফুলী নদীর সাথে। ভাটার সময় সেই খালে পানি কমে গিয়ে ঘোলা জল ও পায়ের সাথে লেপ্টে থাকা কাদা মাটি দেখা যেতো। আবার জোয়ারে নদীর উপচে পড়া জল আপন খেয়ালে ছুটে এসে সেই খাল ও খালের পাশের লোকালয়ে আনন্দ ছড়িয়ে দিতো। সেই নদীর জল খালি হাতে আসতো না! সাথে করে মিঠাপানির বিচিত্র প্রজাতির মাছ নিয়ে আসতো।
তখন বাড়ি-ঘরে বুবুরা যত্ন করে কাপড়ে সুই-সুতায় ফুল তুলে গুরুত্বপূর্ণ বাণী লিখে আয়না বাঁধাই করে ঘরের বেড়ায় টাঙিয়ে রাখতো। সাদা কাপড়ে কালো সুতায় লেখা ছিল, ‘অভাব যখন দুয়ারে এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়।’ ভয়াবহ অভাব কেবল দুয়ারে এসে দাঁড়ায়নি! ঘরের অন্দরমহলে প্রবেশ করে বসবাস শুরু করে দিলো। চরম অর্থকষ্টের দিনে চেনাজানা প্রতিবেশী ও বাড়িওয়ালা স্বজনদের প্রবল অসহযোগিতাকে মোকাবিলা করে টিউশনি এবং পরবর্তীতে সরকারি চাকরি করে পরিবারের অভাব বিরোধী লড়াইয়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন মেজো আপা আনোয়ারা বেগম। আমার দীর্ঘ বেকার জীবনে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা দিয়ে পাশে ছিলেন। আপা এবং আপার নামের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং দুর্বলতা রয়ে গেছে।
ঘটনাচক্রে আপার শ্বশুরবাড়ি হয়ে গেলো আনোয়ারা উপজেলায়। সেই সুবাদে আনোয়ারা বহুবার যাওয়া-আসা করেছি। শঙ্খ নদীর পাড়ের তৈলারদ্বীপ আনোয়ারা যাওয়া-আসার স্মৃতি এখনো আনন্দ দেয়। যদিও সেই সময়ে যাওয়া-আসার পথ এত সহজ ও উন্নত ছিল না। বর্ষাকালে নদী-খাল পাড়ি দিয়ে, শীতকালে চান্দের গাড়ি ছিল যাতায়াতের মাধ্যম। দীর্ঘসময় নিয়ে যাওয়া-আসা ক্লান্তিকর ছিল। মোটেও বিরক্তিকর মনে হতো না। আপাদের শ্বশুরবাড়ি ছিল মাটির দুইতলা। আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারি, আমড়া, জাম্বুরা যাবতীয় ফলের গাছে সমৃদ্ধ ছিল। আপারা শহরে বাড়ি-গাড়ি করে নাগরিক হয়ে গেছেন। আপারাই যেখানে বছরে দু’একবার যাওয়া-আসা করেন; সেখানে আমার যাওয়াটা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।
রক্তের সম্পর্কের যোগাযোগ অবস্থানগত দূরত্বের কারণে ক্রমশ কমে আসে। ভালো লাগা, ভালোবাসায় গড়ে ওঠা আত্মার সম্পর্ক দূরে থেকেও কাছে রাখে। না দেখেও মন দেখার প্রশান্তি নেয়। তেমনই তরুণ কবি ও সম্পাদকের প্রেমে পড়েছিলাম। সেই প্রিয় উপজেলা আনোয়ারার স্থায়ী বাসিন্দা। আনোয়ারায় হাজার হাজার মানুষ রয়েছেন। ঐতিহ্যবাহী দেয়াঙ পাহাড় রয়েছে। সেই ‘দেয়াঙ’ নামের নজরকাড়া একটি শিল্প-সাহিত্যের কাগজ দেখে চমকে উঠেছিলাম। নিজ গরজে কিনে নিলাম। সেই ‘দেয়াঙ’র মাধ্যমে খুঁজে পেলাম কবি ও সম্পাদক মাহমুদ নোমানকে।
আনোয়ারা সদরে জন্মভিটায় বসবাস করেন। ‘দেয়াঙ’র দশটি সংখ্যা প্রকাশ করে ফেলেছেন। প্রতিটি সংখ্যা বিষয়বৈচিত্র্য, লেখা ও সম্পাদনায় একটি আরেকটিকে ছাড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি সেই ‘দেয়াঙ’র টানে আনোয়ারা ছুটে গিয়েছিলাম। তার মায়ের হাতে রান্না করা সবজি ও মাছের কারি দিয়ে আহার করে কিনে নিলাম ‘দেয়াঙ’ মাছ সংখ্যা। মাহমুদ নোমান নির্দ্বিধায় বলেন, ‘আঁইতো পঅল (আমিতো পাগল)।’ পাগলামির মাত্রা ছাড়িয়ে না গেলে ধারদেনা করে কেউ সাহিত্যপত্রিকা করেন না!
একমাত্র ছেলে মাহমুদ ইসতাকের তোলা ছবিতে প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী ও কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। প্রচ্ছদের মডেল হলেন সম্পাদক নিজেই। ডানহাতে উঁচিয়ে ধরা মাছের ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল মাহমুদ নোমান। প্রতিবারের মতো এবারও মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে মায়ের হাতে নতুন দেয়াঙ তুলে দিয়ে মোড়ক উন্মোচন করলেন।
‘মাহমুদ নোমান বলছি’ শিরোনামের দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে গভীর প্রত্যয় নিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন। এত অর্থ সংকট সয়ে ধারদেনায় ‘দেয়াঙ’ করা নিয়ে অনেকের মতো আমিও প্রশ্ন করেছিলাম। এই প্রশ্নের সুন্দর জবাব দিয়েছেন সম্পাদকীয়তে—হালদা নদী থেকে পোনা বাড়ি বাড়ি এনে বিক্রেতার কথা মনে পড়লো—উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আংকেল ডেকসি নাড়াচ্ছেন কেন? একটু এদিক এসে চা খেয়ে যান। তখন তিনি বললেন, না নাড়ালে পোনা মরে যাবে, সেজন্য হাতে নাড়াতে না পারলেও পায়ে ঠেলে হলেও পোনা বাঁচিয়ে রাখছে।অতএব, এইসবের অর্থ হলো—আমি জানি হারিয়ে যাওয়া দেশি ধান, দেশি মাছ সবাই মিলে হারিয়ে দিয়েছি কিংবা তাড়িয়ে দিয়েছি। আমরা পরনির্ভরশীল, পরকথায় চলা জাতি। নিজেদের কিছুকে ভালো মনে করি না। এমনকি এসব কাজে কারো সহযোগিতা পাই না, তবুও করি ওই একটা কারণে—আমি যতদিন আছি আমার বাঙালি শেকড় খুঁজে যাবো, যতদিন পারি ওই পোনার ডেকসি নাড়ানোর মতো নেড়ে যাবো...এতে কিছুই না হোক, আমি অন্তত বাঙালি এই সুখবাদ নিয়ে মরতে পারবো...
আরও পড়ুনসারেঙ হেলাল হাফিজ সংখ্যা: উজ্জ্বলতম সংকলনকবি হারিসুল হক: শব্দের অনন্য জাদুকর
০২‘মাছে ভাতে বাঙালি’ কথাটি বহু প্রচলিত হলেও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। যতই আধুনিক নগর গড়ে নিত্য নতুন ফাস্টফুড খেয়ে সাময়িক স্মার্টনেস জাহির করি না কেন, থালাভর্তি ভাত না খেলে আমাদের ক্ষুধা মেটে না। প্রধান খাদ্য ভাতকে মুখরোচক করে তোলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের তরকারি। আমাদের বাপ-দাদার ভিটেবাড়িতে একটি পুকুরের উপস্থিতি অবধারিত ছিল। সেই পুকুর জলে পরিকল্পনা করে মাছের চাষ করা হতো। পরিকল্পনার বাহিরে নানান প্রজাতির দেশীয় মাছের বিচরণ ছিল। বাড়ির পাশের এঁদো ডোবায়, ধান চাষের জমিতে, খালে ও নদীতে কত বিচিত্র মাছের বিচরণ ছিল। ইচ্ছেমতো সময়ে সুযোগে জাল দিয়ে, বড়শি ফেলে সেসব মাছ ধরে এনে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিলি করা হতো।
আমরা যারা গ্রামের পরিবেশে বেড়ে উঠেছি; তাদের মাছ ধরার মজার মজার সব স্মৃতি আছে। পুকুরে জাল ফেলে বড় শোল মাছ পড়লে জলে নেমে ডুব দিয়ে জালের চারিদিক মাটিতে আটকে দিতাম। জাল উল্টে পালাতে পারতো না সেসব চতুর শক্তিধর মাছেরা। অতঃপর ডুবের পর ডুব দিয়ে ঘোলা জলে দুই চোখ লাল করে সেই বিশাল দেহের শোল, বোয়াল, চিতল মাছ ধরার স্মৃতি কী করে ভুলি? পুকুর পাড়ে বসে ছোট পুঁটি মাছের বড়শিতে আটার খামি গেঁথে একের পর এক পুঁটি মাছ ধরা, ইটখোলার বড় বড় ডোবার জলে ডুব দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরার মজার দিনগুলো এখনো মনে আনন্দ জাগায়। যদিও অত্যধিক চড়া দামে সব দেশি মাছ কিনতে পাওয়া যায়, সেই আগের মতো পুকুর, বিল, খাল থেকে ধরে এনে খাওয়ার দিন কবেই ফুরিয়ে গেছে!
পুঁজিবাদের বেপরোয়া আগ্রাসন কেবল জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি! প্রাণ প্রকৃতিকে ক্রমাগত বিপন্ন করে তুলেছে। হারিয়ে গেছে মনুষ্যত্ববোধ। সাথে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বিচিত্র প্রজাতির অনেক মাছ। বাঙালি জীবনযাপনের নিত্য সহচর মাছ নিয়ে দেয়াঙ-এর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশকে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে গণ্য করা যায়।
দেশের বিভিন্ন জেলার বিপন্ন মাছ নিয়ে বিভিন্ন লেখকের লেখা আদায় করা বেশ কষ্টকর ছিল। বার বার তাগাদা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত লেখা সংগ্রহ করেছেন পরম নিষ্ঠার সাথে। বিশেষ প্রয়োজনে নিজেই ছুটে গেছেন কোনো কোনো জেলা-উপজেলায়। প্রবন্ধ, গপ্ (সাক্ষাৎকার), প্রিয় মাছ, মাছের কবিতা ও মাছের গল্প নিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন আড়াই শতাধিক পৃষ্ঠার দেয়াঙ। ‘লালন বলে জল শুকালে মীন পালাবে কোথায়’ শিরোনামে আমীন আল রশীদের লেখা দিয়ে দেয়াঙের শুরু হলো। বাউল সাধক লালন সাঁইয়ের কালামে মীন বা মাছের যৌক্তিক ব্যবহার নিয়ে বেশ চমৎকার লিখেছেন। লেখাটি শেষ করেছেন চরম নৈরাশ্যজনক বাস্তবতা দিয়ে।‘লালন হয়তো নদীমাতৃক বাংলাদেশের সংকট বহু আগে টের পেয়েছিলেন। টের পেয়েছিলেন বলেই বলে গেছেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। যেভাবে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো বিপন্ন হয়েছে, তাতে এখন এখানে শুধু মীন বা মাছই নয়, মানুষের জীবন ও বিপন্ন।’ মাছ সংখ্যার প্রতিটি লেখা নতুন ভাবনা, স্বতন্ত্র মাছ, মাছ শিকার করার পদ্ধতি এবং মাছের পরিচিতি লিপিবদ্ধ করেছেন পরম মমতায়। ‘দেশি মাছের হাল হকিকত’র পাশাপাশি ‘গারো ঐতিহ্য সংস্কৃতিতে মাছ ও মাছ ধরার কৌশল’ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
‘জিয়ল মাছ’ নিয়ে কবি জরিনা আখতারের হাহাকার যেন আমাদের মনের কথা বলছে—‘কতদিন মাছ ও ভাতের মিলন হয়নি এ বাড়িতেসানকিতে সাদা ভাত, শাক, একটু নুন নিত্যদিনের বরাদ্দ আহারমা বলেন বাবা এলে মাছ রান্না হবেসাদা ভাতের উপর মাছের টকটকে ঝোলআহ্ অমৃত, খুব মজা করে খাবো’
প্রিয় মাছ নিয়ে কবি রহমান হেনরী বরফনিদ্রায় ঢুকে যাওয়া জীবন্ত মাছকে আহ্বান জানান—‘বরফের নিদ্রা ভাঙো, প্রিয় মাছ, জেগে ওঠো বারিধি দুলিয়ে’। কবি স্বপঞ্জয় চৌধুরীর কাব্যভাষা চিরায়ত সত্য হয়ে আসে আমাদের জীবনে—‘ডুবে আছি মাছের মতো/ জীবন নামক এক অথৈ নদীতে’। ‘ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে সোনাফর। এমন বকতে বকতে আকলিমার হাত ধরে টেনে কাটামাছের মতো ধড়ফড়ায়। একবার এপাশ ওপাশ করেই জেগে ওঠে ধড়মড় করে।’ মঈনুল হাসানের গল্প ‘সোনাফরের চোখ’ পড়লে জানা যায় এ কথা। খালিদা তালুকদারের গল্প ‘যে জীবন জলের’ আমাদের আহ্লাদিত করে। ‘একগাল হাসি ভরা মুখে বলেছিলেন, খুউব ভালো সময় দ্যাশে আইছো বাজান! অনেক দিন বাদে বিলে এবার বড় বড় কৈ মিলতাছে, এবার তোমারে দেশি কৈ খাওয়াইতে পারব!’
আমাদের ইট-পাথরের নগর জীবন স্যুটেট বুটেট সাহেব বানিয়ে সচল রাখলেও আমরা যেন ক্রমাগত নিজেদের অবচেতনে আধমরা হয়ে পড়েছি! না মরা, না বাঁচা এই জীবনে খানিকটা স্বস্তির সুবাতাস ছড়িয়ে দেয় শিল্প সাহিত্য ও সংগীত। কল্পনায় নিজের ভুবনে ফিরিয়ে নেয়। তেমনি সুদূর অতীতের জলজ জীবনে উন্মুক্ত বিচরণ করতে ‘দেয়াঙ’ অনেকখানি সহায়তা করবে। সম্পাদকের সাথে ইনবক্সে যোগাযোগ করে দেয়াঙ সংগ্রহ করুন। নিজেকে মনে-প্রাণে নবোদ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলুন।
দেয়াঙ প্রিয় মাছসম্পাদক: মাহমুদ নোমানআনোয়ারা সদর, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিতপ্রতি কপির বিনিময় ৩৫০ টাকা।
এসইউ/জেআইএম