মানুষের মনে চিন্তা আসা স্বাভাবিক, কিন্তু কিছু চিন্তা যখন বারবার মাথায় ঢুকে অস্বস্তি সৃষ্টি করে এবং কোনো কাজ বারবার করতে বাধ্য করে, তখন সেটাই হয়ে ওঠে ওবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার, সংক্ষেপে ওসিডি।
এই আচরণগুলোর মধ্যে খুব কমন একটি হলো – পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অস্বাভাবিক খুঁতখুঁতে স্বভাব। আমরা অনেকসময় একে হালকাভাবে শুচিবায়গ্রস্ত আচরণ বলে থাকি। তবে শুচিবায় ও ওসিডি এক নয়।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা বলছে, এই মানসিক অবস্থাটি শুধু অভ্যাস নয়; বরং মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু সার্কিট, বিশেষ করে কগনিটিভ–কন্ট্রোল এবং এমোশন–রেগুলেশন অংশের অতিরিক্ত সক্রিয়তার সঙ্গে যুক্ত।
কেন এমন চিন্তা বারবার আসে?২০২৪–২৫ সালের নিউরোসায়েন্সভিত্তিক দুটি গবেষণা (স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, জার্নাল অফ সাইকিয়াট্রিক রিসার্চ) বলছে, ওসিডি–তে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক হুমকি বা ঝুঁকির সিগন্যালকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে সামান্য সন্দেহও অনেক বড় বিপদ বলে মনে হয়।
সেই চিন্তা একবারে বন্ধ না হয়ে বারবার ফিরে আসে, আর সেই চিন্তা কমাতে ওই ব্যক্তি নির্দিষ্ট আচরণ বারবার করেন। যেমন — হাত ধোওয়া, দরজার লক করা যাচাই, নামাজ বা প্রার্থনার লাইনে পুনরাবৃত্তি, বিভিন্ন বিষয় গণনা করা ইত্যাদি।
এই পুনরাবৃত্ত আচরণগুলোকে বলা হয় কমপালশন, যা সাময়িক স্বস্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা বাড়ায়।
ওসিডি শুধু পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার বিষয় নয়জার্নাল অফ অ্যাংজাইটি স্টাডিজ–এর একটি ২০২৪ সালের গবেষণা বলছে, ওসিডির উপসর্গ অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ। যেমন -
১. কনট্যামিনেশন ভয়: অতিরিক্ত জীবাণুভীতি
২. চেকিং কমপালশন: বারবার দরজা বা চুলা দেখার প্রবণতা
৩. হার্ম–ওবসেশন: নিজের বা অন্য কারও ক্ষতি হয়ে যাবে, এমন অযৌক্তিক ভয়
৪. অর্ডার ও কাউন্টিং: সবকিছু নিখুঁতভাবে সাজানোর চাপ অনুভব করা
অর্থাৎ, ওসিডি মানেই শুধু ‘অতিরিক্ত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা’ নয়, এটি চিন্তার গভীর অস্থিরতার একটি মানসিক স্বাস্থ্যজনিত অবস্থা।
ওসিডি কি বংশগত?গবেষণা বলছে, এটি আংশিকভাবে বংশগত। হার্ভার্ড–এমআইটি ব্রেইন ইনিশিয়েটিভের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ বলছে—
>> ওসিডিতে জেনেটিক ভূমিকা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ
>> পারিবারিক পরিবেশ ও শৈশব–অভিজ্ঞতা বাকি অংশে ভূমিকা রাখে
>> পরিবারের কারও ওসিডি থাকলে অন্য সদস্যেরও ঝুঁকি কিছুটা বাড়ে
>> চিকিৎসা—আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উপশম সম্ভব
বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ওসিডির দুটি চিকিৎসা সবচেয়ে বেশি কার্যকর -
১. কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (সিবিটি)সিবিটির একটি উপ–পদ্ধতি ইআরপি (এক্সপোজার অ্যান্ড রেসপন্স প্রিভেনশন) ওসিডি চিকিৎসার ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ ধরা হয়। এতে ধীরে ধীরে সেই ভীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করা হয়, তবে ব্যক্তি যেন বারবার একই আচরণ না করেন, এটি নিশ্চিত করা হয়।
২. ওষুধঅনেক ক্ষেত্রে ওষুধ রোগীর উপসর্গ কমিয়ে রোগীকে থেরাপিতে অংশ নিতে সক্ষম করে। ২০২৫ সালের জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রি-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিবিটি ও ওষুধ একসঙ্গে ব্যবহার করলে উন্নতির হার একক চিকিৎসার তুলনায় বেশি।
ওসিডি কি পুরোপুরি ভালো হয়?ওসিডি আসলে একটি ক্রনিক অবস্থা, তবে সঠিক চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফিরে আসে। অনেক মানুষ দীর্ঘমেয়াদে স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন, চাকরি, পরিবার, সম্পর্ক—সব ঠিকঠাক রাখেন।
কখন বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন?১. যদি চিন্তা বারবার ফিরে আসে ও দিনযাপন ব্যাহত হয়
২. একই কাজ দিনে বহুবার করতে হয়
৩. ঘুম, কাজ, পড়াশোনা, সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়
৪. ভয় বা সন্দেহের কারণে বাইরে যাওয়া কমে যায়
তাহলে দেরি না করে মনোরোগ–বিশেষজ্ঞ বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের সাহায্য নিন।
ওসিডি কোনো ‘বদ–অভ্যাস’ নয়, ‘ইচ্ছে করলেই ঠিক হয়ে যাবে’ — এমনও নয়। এটি একটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা, যার মূল কারণ মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট সার্কিটের অতিরিক্ত সক্রিয়তা।
সঠিক চিকিৎসা নিলে উপসর্গ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে এবং ব্যক্তি নিজের দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যেতে পারেন।
সূত্র: স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, হার্ভার্ড–এমআইটি ব্রেইন ইনিশিয়েটিভ, জার্নাল অফ সাইকিয়াট্রিক রিসার্চ, জার্নাল অফ অ্যাংজাইটি স্টাডিজ, জার্নাল অফ ক্লিনিকাল সাইকিয়াট্রি
এএমপি/জেআইএম