রাজনীতি

চিকিৎসায় বারবার ‘হোঁচট’, তবুও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন খালেদা জিয়া

খালেদা জিয়া হাসপাতালে। শারীরিক অবস্থাও সংকটাপন্ন। এমন খবরে গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে ভিড় করছেন তার দলের নেতাকর্মী-সমর্থকরা। জড়ো হচ্ছেন সাধারণ মানুষও। সবার একটাই জিজ্ঞাসা- এখন কেমন আছেন সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী?

খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা গত কয়েক দিনে আরও অবনতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা। সোমবার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান বলেন, ‘সিসিইউ থেকে আইসিইউ, আইসিইউ থেকে ভেন্টিলেশন, যা-ই বলি না কেন, ম্যাডাম খুব ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছেন। এর বাইরে বলার মতো কিছু নেই। শুধু ম্যাডামের জন্য জাতির কাছে দোয়া চাই।’

এর আগে রোববার (৩০ নভেম্বর) তিনি হাসপাতালের শয্যায় অল্প নড়াচড়া করেছেন, কথাবার্তায় সাড়াও দিয়েছেন। চিকিৎসকরা বলেন, দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। এই মুহূর্তে দেশেই সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা নিশ্চিত করে তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ।

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক জটিলতা নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরে নানান ধরনের গুরুতর রোগে ভুগছেন তিনি। চিকিৎসার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, অনেক বছর ধরেই খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস এবং চোখের সমস্যাসহ নানান জটিলতায় ভুগছেন। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন সবশেষ জানান, ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের গুরুতর সংক্রমণ নিয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।

কারাগারেও গুরুতর অসুস্থ ছিলেন খালেদা

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পরের দুই বছর দুই মামলায় দণ্ডিত হয়ে তিনি পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে একাকী সময় কাটান। সে সময় কারাগারে নিলে তার স্বজনরা সাক্ষাৎ করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘খালেদা জিয়া অসুস্থ। এ কারণে তিনি দেখা করতে পারবেন না।’

আরও পড়ুনখালেদা জিয়ার কোন মামলার কী হাল?পরিত্যক্ত লালদালানে রাত কাটবে খালেদা জিয়ার৪ বছরে ৮ মাসই হাসপাতালে ছিলেন খালেদা জিয়া

এ তথ্য জানিয়ে পরে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘খালেদা জিয়ার পা, হাঁটুসহ সারা শরীরে ব্যথা এতটাই তীব্র হয়েছে যে, তিনি তার জেলকক্ষ থেকে ওয়েটিং রুম পর্যন্ত আসতে পারেননি।’ সরকারের নির্দেশিত মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়াকে অর্থপেডিক বেড দেওয়ার জন্য যে সুপারিশ করেছিল সেটিও কারা কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করেনি বলে জানান রিজভী।’

ওই সময় ডয়চে ভেলে এক প্রতিবেদনে জানায়, খালেদা জিয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা কারাগারে একজন চিকিৎসক থাকেন। রাতে কেবল তার জন্যই একজন চিকিৎসক কারা ফটকের একটি কক্ষে ঘুমান। তার পাশের রুমেই থাকেন একজন নার্স। কারাগারের ভেতর নিয়মিত হাঁটাচলাও করছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

কারাগারে থাকাকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য খালেদা জিয়াকে কয়েকবার বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। যদি দেশে সে সময় তার পছন্দ ছিল ইউনাইটেড হাসপাতাল। বারবার আবেদনেও আওয়ামী লীগ সরকার চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেয়নি। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে সবশেষ তিনি বিদেশ যান। তাকে বিদেশে নিতে আন্দোলন-বিক্ষোভও করেন তার দলের নেতাকর্মীরা।

একাধিকবার নেওয়া হয় হাসপাতালে

কারাবন্দি অবস্থায় খালেদা জিয়াকে একাধিকবার বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (তৎকালীন বিএসএমএমইউ) নেওয়া হয়। যদিও দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, খালেদা দেশে শুধু ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চান। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে হাসপাতালে সাক্ষাৎ করতে পারেন খালেদার পরিবারের কয়েকজন সদস্য। পরে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর খালেদা জিয়ার বড় বোন বেগম সেলিমা ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, খালেদা জিয়া উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। তার সারা শরীরে ব্যথা। এমনকি মুখে তুলে খেতেও পারেন না। এরপরও তাকে কয়েকবার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়।

আরও পড়ুনখালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে রাজনীতিবিজয়ের মাসে বিএনপির ‘মশাল রোড শো’ স্থগিতখালেদা জিয়ার অবস্থা সংকটাপন্ন, বিদেশে নেওয়ার মতো স্থিতিশীল নয়

করোনা আক্রান্তও হন ২০২১ সালে

২০২১ সালের মে মাসে ঢাকায় নিজের বাসায় বন্দি থাকা অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হন খালেদা জিয়া। শ্বাসকষ্টে ভোগার কারণে তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। তখনও তিনি মূলত হার্ট, কিডনি ও লিভারসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছিলেন, যা তার শারীরিক অবস্থাকে জটিল করে তুলেছিল।

লিভার সিরোসিস শনাক্ত হয় একই বছর

খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন ২০২১ সালে। ওই সময় সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সবশেষ তথ্য তুলে ধরেন তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা। খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা বলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তারা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা করার জন্য পরিবারকে বলেছেন।

২০২২ সালে হার্ট অ্যাটাক, মেইন আর্টারির ৯৯ শতাংশ ব্লক

খালেদা জিয়া তখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা। সে বছর জুনের দিকে হঠাৎ একদিন মধ্যরাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে ঢাকার একটি হাসপাতালে নিয়ে এনজিওগ্রাম করানো হয় তার। দেখা যায়, তার মেইন আর্টারির ৯৯ শতাংশ ব্লক। পরে রিং বসানো হয় হার্টে। এর আগে থেকেই তার হার্টে তিনটি ব্লক ছিল।

২০২৪ সালে খালেদা জিয়ার হার্টে পেসমেকার স্থাপন

২০২৪ সালের জুনে দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের বৈঠকে তার শরীরে পেসমেকার বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেময় তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ম্যাডামের হৃদরোগের সমস্যা আগে থেকেই ছিল। হার্টে ব্লক ছিল। আগে একটা রিং পরানো হয়েছিল। সবকিছু পর্যালোচনা করে মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে পেসমেকার বসানো হয়।’

আরও পড়ুনদেশ যেন আজ খালেদা জিয়াকে ঘিরে কাঁদছে: আলাল৩ দিন ধরে একই অবস্থায় খালেদা জিয়া, এভারকেয়ারেই চিকিৎসা চলবেদেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের নিয়েই খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে: ফখরুল

অভ্যুত্থানের পর বিদেশে চিকিৎসা খালেদা জিয়ার

২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে সব দণ্ড থেকে পুরোপুরি মুক্তি দেওয়া হয় খালেদা জিয়াকে। এরপর চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যান তিনি।

পরে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘ম্যাডামের নানা শারীরিক জটিলতা রয়েছে, যা আমরা বিভিন্ন সময় বলেছি। সর্বোপরি ওনার লিভারের জটিলতা অর্থাৎ লিভার সিরোসিস পরে কম্পেনসেন্টারি লিভার ডিজিজ বলে গ্রেট-টু সেটার জন্য টিপস (চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশেষ পদ্ধতি টিআইপিস-টিপস) করা হয়েছে। টিপসের কিছু টেকনিক্যাল অ্যাসপেক্ট আছে অ্যাডজাস্টমেন্টের বিষয় আছে… আপনি দেখতে হার্টে স্টান্টিং করার পর চেক করে আবার সেটার জন্য রি-স্টান্টিং করে অথবা চেক করে দেখে যে, স্টান্টিংটা ভালোভাবে কাজ করছে কি না… এই জিনিসগুলো তো আমরা করতে পারি নাই।’

‘হার্টে উনার ব্লক ছিল একাধিক। আমরা খালি লাইফ সেভিং যেটুকু পোরসন সেটুকু করা হয়েছিল ওই সময়ে। কারণ ওই সময়ে উনার শারীরিক সুস্থতা ওইরকম ছিল না। ওনার আরও যে ব্লক আছে সেটা অ্যাড্রেস করার দরকার আছে, ওনার ক্রনিক কিডনি ডিজিজ যেটা আছে সেটা অ্যাড্রেস করতে হবে… উনার করোনা পরবর্তিতে কিছু জটিলতা হয়েছে সেগুলো নিরসন করার ব্যবস্থা নিতে হবে… এটা ওভারঅল থ্রো চেকিংয়ের জন্য যেটা আমাদের দেশে হয়েছে... আমাদের দেশের ফিজিশিয়ানরা, এভারকেয়ার হাসপাতালের স্টাফ তারা বেস্ট…. এ ব্যাপারে আমাদের ম্যাডামের পক্ষ থেকে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে, পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ডি-স্যাটিসফেকশন নাই, সবাই হ্যাপি, উই আর হ্যাপি অলসো, দল হ্যাপি। কাজেই আরও কিছু উন্নত করার জন্য সেখানে আরও থ্রো চেকিং হবে।’

প্রায় চার মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে দেশেই চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।

সশস্ত্র বাহিনীর অনুষ্ঠান থেকে এসে ফের অসুস্থ

সবশেষ গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরেন। এরপর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শ্বাসকষ্ট তীব্র হয়। এ অবস্থায় গত ২৩ নভেম্বর তাকে জরুরিভিত্তিতে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং চিকিৎসকরা জানান তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। সঙ্গে আরও কিছু জটিলতা আছে। তার কিডনি ডায়ালাইসিসও করতে হয়েছে।

এদিকে সোমবার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান বলেন, ‘সিসিইউ থেকে আইসিইউ, আইসিইউ থেকে ভেন্টিলেশন, যা-ই বলি না কেন, ম্যাডাম খুব ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছেন। এর বাইরে বলার মতো কিছু নেই। শুধু ম্যাডামের জন্য জাতির কাছে দোয়া চাই।’

এসএনআর/এএসএ/জেআইএম