মওলবি আশরাফ
হজরত শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.) যখন আল্লাহর ইশারায় এই বঙ্গভূমিতে আগমন করেন, তখন তিনি একা আসেননি, বরং তার সঙ্গে ৩৬০ জন শিষ্যও এসেছিলেন। সেই শিষ্যগণ ১৩০৩ সালে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর নেতৃত্বে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেন, এবং এই অঞ্চলের মানুষদের ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদের জুলুম থেকে উদ্ধার করেন। তাদের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ এক শিষ্য ছিলেন হজরত শাহ পরান ইয়েমেনি (রহ), যিনি আজও সিলেট অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত। আজ আমরা তার সম্পর্কেই খানিকটা ধারণা নেব।
জন্ম ও নামশাহ পরানের (রহ.) প্রকৃত নাম ও জন্মসাল নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। কেউ কেউ মনে করেন তার আসল নাম ফারহান—যা এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে বদলে পরান হয়ে গেছে। অন্যদিকে ‘পরান’ শব্দটির অর্থ ‘প্রাণ’ বা ‘জান’। বাংলায় এই শব্দটি ভালোবাসার সম্বোধন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। আবার অনেকে বলেন শাহ পীরান শব্দ থেকেই ‘শাহ পরান’ এসেছে, যার অর্থ ‘পীরদের পীর’।
পরিবার ও শিক্ষাশাহ পরানের (রহ.) বাবার নাম ছিল মুহাম্মদ, যিনি শাহ পরানের বয়স যখন মাত্র ১১ বছর তখনই মারা যান। এরপর তিনি বড় হন তার দাদা সাইয়েদ আহমদ কবিরের (রহ.) তত্ত্বাবধানে। পরে তিনি নিশাপুরের দরবেশ আমিনের কাছেও শিক্ষা লাভ করেন।
হজরত শাহজালাল (রহ.) শাহ পরানের (রহ.) দূরসম্পর্কীয় মামা। তিনি যখন পরিণত বয়সে পৌঁছেন, তখন মামার সাথে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সফর শুরু করেন। এরই সূত্র ধরে তিনি সিলেটে আগমন করেন, এবং বাংলার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যান।
সিলেট বিজয় ও খাদিম নগরে ইসলাম প্রচার১৩০৩ সালে রাজা গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে সিলেট বিজয়ের শেষ যুদ্ধে শাহ পরান (রহ.) খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এরপর সিলেটেই তিনি ইসলামের দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ করতে থাকেন।
এরই মধ্যে একটি ঘটনা ঘটে। কথিত আছে, হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার (রহ.) তরফ থেকে শাহজালালকে (রহ.) যে ‘জালালি কবুতর’ হাদিয়া দেওয়া হয়েছিল, হজরত শাহ পরান (রহ.) সেগুলোর মধ্যে একটি কবুতর ভুলবশত খেয়ে ফেলেন। আরেক বর্ণনায় আছে, শাহ পরান (রহ.) প্রতিদিন একটি করে কবুতর খেতেন। শাহজালাল (রহ.) যখন দেখলেন কবুতরের সংখ্যা অনেক কম, এই ব্যাপারে তার কাছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি আল্লাহর দেওয়া বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে কবুতরগুলো জীবিত করে ফেলেন। কিন্তু এই কারামত দেখে শাহজালাল (রহ.) তার ওপর রাগ করেন। কারণ এই অঞ্চলের মানুষ তখন সদ্য হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছে, যদি তারা এ ধরনের কারামত দেখে, তাহলে শাহ পরানকে (রহ.) দেবতা ভেবে বসবে। ফলে আল্লাহর দেওয়া এই ক্ষমতা মানুষের বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে। তাই তিনি তাকে সিলেট শহর থেকে কিছুটা দূরে খাদিম পাড়া বা খাদিম নগর এলাকায় ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দেন।
শাহ পরান (রহ.) খাদিম নগর ডাকসিংগর এলাকায় পাহাড়চূড়ায় এক খানকা স্থাপন করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি খাদিম নগরে ইসলাম প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন এবং খাদিম নগরে পাহাড়চূড়ার খানকায়ই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বর্তমানে সেই জায়গাটি শাহ পরানের পাহাড় নামে পরিচিত।
শাহ পরান (রহ.) বিবাহ করেননি এবং তার কোনো বংশধরও নেই। তার মৃত্যুর পর তার খানকার পাশে তাকে দাফন করা হয়। কালের পরিক্রমায় সেখানে গড়ে ওঠে একটি বড় দরগাহ কমপ্লেক্স—যার মধ্যে রয়েছে মসজিদ, ঈদগাহ, লঙ্গরখানা, নারীদের নামাজের জায়গা এবং পুকুর।
শত শত বছর ধরে দেশ–বিদেশের অসংখ্য মানুষ শাহ পরানের (রহ.) মাজার ও দরগাহ জিয়ারত করে আসছেন, এ প্রচলন আজও অব্যাহত আছে।
ওএফএফ