হজরত শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.)
মওলবি আশরাফ
বিদায় হজের ভাষণে আল্লাহর রাসুল (সা)-এর নির্দেশনা ছিল—তোমরা আমার কাছ থেকে একটি আয়াত হলেও অন্যের কাছে পৌঁছে দাও। (সহিহ বুখারি: ৩৪৬১) এরপর সাহাবিগণ এবং তার পরবর্তীতে মুসলমানদের প্রত্যেক প্রজন্মই কিছু মানুষ নিজের অঞ্চল ছেড়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ইসলাম প্রচারে ছড়িয়ে পড়েছেন। এই বাংলার মাটিতেও এ রকম অনেক ইসলাম প্রচারকের আগমন ঘটেছে। তবে হজরত শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.) ছিলেন এমন একজন, যার নাম বাংলার অস্তিত্বের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে, আমরা এই দেশকে ‘শাহজালালের বাংলা’ বলে ডাকি। কে ছিলেন এই মহান সুফি, আজ আমরা তার সম্পর্কেই জানব।
জন্ম ও প্রথম জীবন
গবেষকদের অধিকাংশের মত অনুযায়ী, হজরত শাহজালাল (রহ.) ৬৭১ হিজরি মোতাবেক ১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে ইয়েমেনে জন্ম নেন। জন্মের কিছুদিন পরই তার মা ইন্তেকাল করেন। আর তার বয়স পাঁচ বছর হওয়ার আগেই পিতা মুহাম্মদ (রহ.) কোনো এক জিহাদে অংশগ্রহণ করে শহীদ হন। তখন তার মামা সাইয়েদ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি তাকে দত্তক নিয়ে লালন-পালন করেন। শৈশবেই তিনি কোরআন হিফজ করেন, আরবি শাস্ত্রে পড়াশোনা শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে ইসলামি জ্ঞানে অগাধ পাণ্ডিত্ব অর্জন করেন।
আধ্যাত্মিকতার চর্চা
হজরত শাহজালালের আধ্যাত্মিক গঠন মূলত সোহরাওয়ার্দি তরিকায়। তার পীর ছিলেন সাইয়েদ আহমদ কবির, যিনি পবিত্র শহর মক্কায় শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দির প্রতিষ্ঠিত খানকার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। এই খানকাতেই হজরত শাহজালাল শরিয়ত ও মারেফতের শিক্ষা নেন। দিনভর ইলমচর্চা আর রাতভর ইবাদত—এভাবেই তার যৌবনকাল কাটে। পরবর্তীতে সুফিদের নিয়ম অনুযায়ী তিনি ‘খেলাফত’ পান, এবং অনেকেই তার মুরিদ হন। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলেন তার ৩৬০ শাগরেদ, যারা তার সাথে বাংলায় এসেছিলেন। এর মধ্যে সাইয়েদ নাসিরুদ্দিন, গাজি বুরহানুদ্দিন, শাহ পরান, হাজি ইউসুফ, আজিজ চিশতি অন্যতম—তারা বাংলার মাটিতে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

সিলেটে আগমন
হজরত শাহজালাল (রহ.) এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন, পূর্ব দিকে এক সবুজ ভূমি আছে, যেখানে অসংখ্য মানুষ তওহিদের দাওয়াতের জন্য অপেক্ষমান। এই স্বপ্ন তিনি মামা ও মুর্শিদ সাইয়েদ আহমদ কবিরকে বললে, তিনি তাকে হিন্দুস্তানে যাওয়ার ইজাজত দেন এবং হাতে এক মুঠো মাটি দিয়ে বলেন—যে জায়গার মাটির সঙ্গে এই মাটির রং, গন্ধ আর স্বাদ মিলবে, সেখানেই ঘাঁটি গাড়বে।
এরপর ১৩শ শতকের শেষ ভাগে তিনি মক্কা থেকে রওনা হয়ে সমরকন্দ, বুখারা, বাগদাদ হয়ে দিল্লিতে পৌঁছান। সেখানে তার দেখা হয় দিল্লির বিখ্যাত ওলি হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার (রহ.) সঙ্গে; বিদায়ের সময় খাজা নিজামুদ্দিন (রহ.) তাকে যে সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন, লোকমুখে সেই বংশের কবুতরই ‘জালালি কবুতর’ নামে পরিচিত। সিলেটের দরগাহ এলাকায় আজও প্রচুর ‘জালালি কবুতর’ দেখা যায়।
হজরত শাহজালালের (রহ.) আগমনের সংবাদ পেয়ে তৎকালীন শ্রীহট্টের রাজা গৌড়গোবিন্দ তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। গৌড়গবিন্দের বাহিনী শাহজালালের (রহ.) সঙ্গীদের দিকে অগ্নিবাণও নিক্ষেপ করে। কিন্তু তাদের অগ্রযাত্রা রোধ করা সম্ভব হয়নি। এরপর বরাক নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয় যেন শাহজালাল (রহ.) ও তার সঙ্গীরা নদী অতিক্রম করতে না পারেন। তখন হজরত শাহজালাল জায়নামাজে বসে নদী পার হয়ে যান। এই গল্প প্রাচীন গ্রন্থ ‘তাওয়ারিখে জালালিতে’ উল্লেখ আছে।
গৌড়গোবিন্দের সাথে যুদ্ধ
অসহিষ্ণু ও সাম্প্রদায়িক হিন্দু রাজা গৌড়গোবিন্দের শাসনামল ছিল ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে। তার শাসনাধীন অঞ্চলে বসবাসরত গাজি বুরহানুদ্দিন নামের এক মুসলিম তার ছেলের আকিকা উপলক্ষে গরু জবাই করেছিলেন। ঘটনাক্রমে একটি চিল এক টুকরো গোশত নিয়ে এক ব্রাহ্মণের ঘরে (অন্য বর্ণনায় মন্দিরে) নিয়ে ফেলে। এ কারণে গৌড়গোবিন্দ ক্ষিপ্ত হয়ে বুরহানুদ্দিনের হাত কেটে ফেলে, একই সাথে নিষ্পাপ শিশুটিকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। বুরহানুদ্দিন গৌড়ে গিয়ে গৌড়ের তৎকালীন সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের (রাজত্ব ১৩০১–১৩২২ খ্রি) কাছে বিচার চান। সুলতান প্রথমে সিকান্দর খান গাজিকে পাঠালেও ২ বার তিনি পরাজিত হন। এরপর সেনাপতি নাসিরুদ্দিন ও সুলতানি বাহিনী যখন আবার প্রস্তুত হচ্ছিল, তখনই ৭০৩ হিজরি/১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে হজরত শাহজালাল (রহ.) তার প্রায় ৩৬০ জন সঙ্গীসহ বাংলায় আসেন। পুরো কাহিনি জানার পর তারা জালেম গৌড়গবিন্দের কবল থেকে বাংলার মানুষকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এবার মুসলিম বাহিনী জয়লাভ করে, এবং গৌড়গোবিন্দ পালিয়ে যান।
ইবনে বতুতার বর্ণনায় শাহজালাল (রহ.)
বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ৭৪৬ হিজরি/১৩৪৫–৪৬ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁও হয়ে সিলেটে যান এবং হজরত শাহ জালালের (রহ.) খানকায় তিন দিন অবস্থান করেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী শাহজালাল (রহ.) ছিলেন অত্যন্ত শীর্ণকায় এক বুজুর্গ দরবেশ যিনি সারা রাত নামাজ আদায় এবং প্রায় সারাবছর রোজা রাখতে অভ্যস্ত ছিলেন।

ইন্তেকাল
অধিকাংশ বর্ণনা অনুযায়ী ৭৪৬ হিজরি/১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি ইন্তেকাল করেন এবং সিলেট শহরের পাহাড়ি টিলায় তাকে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে সেখানে তার মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। আজও প্রতিদিন হাজারও মানুষ তার মাজার জিয়ারত করতে যায়।
ওএফএফ