সাহিত্য

সানাউল্লাহ সাগরের কবিতার পাঠ

তরুণদের কবিতা বেগবান। শব্দের পর শব্দ গেঁথে, তাকে একটি মালায় পরিণত করাই কবিতার আরাধ্য, লক্ষ্য। বিশ শতকে বাংলা কবিতা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছেছে। ভাষা ও ভাষ্যে, বাচ্যে ও বক্তব্যে এবং তার শিল্প ও দার্শনিকতায় গত শতক চিহ্নিত হয়ে আছে বাঙালির ভাবদর্শনের চূড়ান্ত বিজয়ের স্মারক রূপে। সেই অর্থে, একবিংশ শতকের কবিতা ও কাব্যদর্শন নতুন কোনো ভাব-আন্দোলনের জন্মচিহ্ন সূচিত না করলেও একটা ভাষিক ভঙ্গী ও ভাব নির্মাণে অসংখ্য কবি প্রকাশ করেছেন তাদের সমূহ গন্তব্যের দিকরেখা, স্পষ্টতা। হয়তো, এর মধ্যদিয়েই ইতিহাস সূচিত হবে। জীবন ও প্রকৃতি, প্রযুক্তি ও সভ্যতা, এই নানামুখী সমীকরণের ভেতর দিয়ে বিশ্ববোধের দীক্ষা মিলবে― এদের বাকপ্রতিমায় ভাব ও ভাষায়। তাদেরই একজন তরুণ কবি সানাউল্লাহ সাগর। তার কবিতার বিষয় ভাবনা ও কবিতায় চারিত্র্য নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করবো।সানাউল্লাহ সাগরের জন্ম ১৯৮৭ সালে, বরিশালে। লেখালেখি শুরু করেন ২০০৩ সালে। এরপর থেকে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য বিভাগ, সাহিত্য পত্রিকাসহ দুই বাংলার লিটলম্যাগে প্রায় একযুগ ধরে লিখছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সম্পাদনা করছেন সাহিত্যবিষয়ক ছোটকাগজ ‘আড্ডা’। ইতোমধ্যে তার তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে- ১. অলৌকিক স্বপ্নের যৌথ বিবৃতি (২০১৩)২. সাইরেন (২০১৫)৩. কালো হাসির জার্নাল (২০১৬)।‘অলৌকিক স্বপ্নের যৌথ বিবৃতি’ কাব্যগ্রন্থে ৫০টি কবিতা রয়েছে। কয়েকটি কবিতার শিরোনাম- পিরোজপুর-১৯৯৫, ঘোলামেঘ, আহত মেঘজল, স্বপ্ন কবুতর, নক্ষত্রের ডানায়, জোছনার নোটিশ, মৃত স্বপ্নের বিবৃতি, ডাকবাক্স, রংধনু, গোলবিছানা, ঘুমপাখি, অলৌকিক স্বপ্নের যৌথ বিবৃতি প্রভৃতি। এসব কবিতার মর্মমূলে রয়েছে স্মৃতিকাতরতা, বিরহ-প্রেম, সমাজবীক্ষণ, মনস্তত্ত্ব, অাত্মবোধ, ব্যক্তি-রাষ্ট্র ও তার সম্পর্ক প্রভৃতির বয়ন।স্মৃতিকাতরতা জীবনের সংরাগে মূর্ত হয়, আবেগে ঋদ্ধ হয়। ফলে কবিতায় তা হয়ে ওঠে অাবেগ-বিজ্ঞান। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক-    ১. ‘মায়ামন্ত্র ছিল ঘাসের শিকড়ে-কচি         হাতের স্পর্শে, উচ্ছ্বাসভরা চোখে।’                                     (পিরোজপুর-১৯৯৫)    ২. ‘মমতার আঁচলে রাত্রির বুকে স্বপ্নের আবাসন।’                                     (স্বপ্নের প্রস্থান)    ৩. ‘মধ্যদুপুরে হতাশার চাদর জড়াব না আর’                                     (অনাথের সম্বল)    ৪. ‘শব্দের তালুতে প্রেম প্রেম খেলার নকশা আঁকতে।’                                     (পঁচিশ বছর)এই গ্রন্থে আত্মবোধ দার্শনিকতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। এখানেই ধরা পড়বে মানবিক নির্মাণের ধারাপাত, যা একজন কবির জন্য অপরিহার্য বটে। এরকম নির্মাণের কয়েকটি উদ্ধৃতি দেই-    ১. ‘উন্মত্ততার জলে শুদ্ধ হয় মৃত্তিকা।’                                     (ঘোলামেঘ)    ২. ‘যদি আবার রৌদ্রের সকালে দেখা হয়-         হাসি নিয়ে এসো।’                                     (আহত মেঘজল)    ৩. ‘সুবহে সাদিকের কার্পেটে বাস করি বলে         আলো-আঁধারের খেলা বুঝতে পারি না।’                                      (পরিবর্তন)    ৪. ‘রঙতুলি নিয়ে বসে আছে-         একটা প্রজাপতি আঁকবো         অথবা তোমাকে বানাবো প্রজাপতি...         উড়ে উড়ে ছড়াবে         শ্বাসরুদ্ধ পঙক্তির সৌরভ।’                                     (অলৌকিক)‘অলৌকিক স্বপ্নের যৌথ বিবৃতি’- মূলত একজন কবির জীবনসাধনার স্বাক্ষর। এখানে বাহুল্য আছে, শব্দ ব্যবহারে ত্রুটি আছে, আবার মানবিক নির্মাণের উজ্জ্বল প্রচেষ্টাও আছে। ‘একটা স্বপ্নই বারবার দেখি-/খোলা মাঠে আমি ঘোড়ার পিছনে দৌড়াচ্ছি/চারদিকে তাজ্জব হাজার মানুষ/আমার দিকে তাকিয়ে আছে-’ (ইদানীং ঘুম)। এই স্বপ্ন দেখাই প্রকৃত কবির কাজ। এই গ্রন্থে জীবনের প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে।সাগরের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সাইরেন’। এ গ্রন্থে ৪০টি কবিতা মুদ্রিত হয়েছে। গ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘অদৃশ্য’। কবির সাধনা একটি উপসংহার বাক্যে ফুটে উঠেছে- ‘স্বপ্ন দেখতে দেখতে উড়ে যাবো একদিন...।’ এটি তার মনন ও বুদ্ধির যৌথ সম্মিলন- প্রথম গ্রন্থের অপূর্ণতা এখানে ব্যাপ্তিতে, পূর্ণতায় মিলেছে। নতুন ব্যঞ্জনায় শব্দ গুঞ্জরিত হয়েছে। ফলে, উপভোগ্য হয়ে উঠেছে কবিতা।    ১. ‘কমায় থেমেছি― তুলি হাতে ফুলস্টপ আঁকবো এবার।’                                                                     (যোগফল)    ২. ‘আমি থামলেই পথ থেমে যায়।’                                                (পথ)    ৩. ‘কুড়ানো স্বপ্নের আসবাব নিয়ে ঘরগেরস্তালি আমার।’                                                          (বৃষ্টি হলে কান্না পায়)    ৪. ‘স্মৃতির পাঠশালায় পুরাতন হাওয়া দীর্ঘশ্বাস বিলায়।’                                                           (আততায়ী)‘সাইরেন’ দেশ, কাল, প্রেম-বিরহ ও জরা-ব্যধির গাদ্যিক পাঠ। প্রতিটি কবিতাই উদ্ভাসিত চিত্রকল্পে জীবননিষ্ঠ। কবিতা যে মূলত ব্যক্তিপাঠ- তার প্রমাণ মিলবে এখানে। অভিজ্ঞতা শাসিত শব্দ কবিকে স্বতঃস্ফূর্ত নির্মাণে ধাবিত করেছে। একটি কবিতার সামান্য অংশ উদ্ধৃতি দেই, যেখানে সমাজবৈকল্য দেখবো; কিন্তু কবি তাকেই মানবিক করে তুলেছেন নিখুঁত ভাষায়।    ‘গলির মুখে উবু হয়ে থাকা মুদী দোকান― ভিতরে ডানা ভাঙা     ময়ূর। বৈশ্বিক স্রোতে হাসি হারানো ময়ূরী নিশ্চুপ। কিছুটা      অন্ধকার তারও প্রেরণা-বেঁচে থাকার ভরসা।’                                                        (গুহা)― কবিকে জীবনের কাছে দাঁড়াতে হয়। ‘সাইরেন’ সেই পথেই মূর্ত হয়েছে।‘কালো হাসির জার্নাল’ কাব্যগ্রন্থে ৪০টি কবিতা। ভাব ও ভাষায়, রূপক ও প্রতীকে আবর্তিত হয়েছে কবির বিষয় ভাবনা। এখানে কবিকে পাবো ধ্যানী ও শান্তরূপে। জীবনকে কবি বহুরূপী আলো ফেলে দেখেছেন, বহুমাত্রিকতায় দেখেছেন। সেই সাথে বিশ্বভাবনার দোলাচল পাই এখানে। ক্লীব ও ক্লীবত্ব, সময় ও সময়ের পাটাতন, মনোবীক্ষণ ও ভূগোল― দেশ ও দৈশিকতা― বহুভুজ রূপায়নে বিচিত্র হয়ে উঠেছে। প্রথমেই এই গ্রন্থের উপমা-রূপকগুলো পরীক্ষা করা যাক।    ১. ‘ফ্যানটা বয়সী বিড়ালের মতো হাফাচ্ছে; আমি ঘুমের সিজদায় নত।’                                                                       (প্রত্যাবর্তনের সুর)    ২. ‘-আবার সূর্যের সাথে মানুষ আবাদে লেগে যাবো।’                                                                       (প্রত্যবর্তনের সুর)    ৩. ‘আর সাবালক নির্মমতার মুখে একফোঁটা বিষাদ তুলে দিয়ে জানিয়ে দিও― তুমিও বেঁচে আছো।’                                                                                                 (দীর্ঘশ্বাসের ওম)    ৪. ‘নির্বাচিত মুহূর্তরা বাঁকা সংলাপে চুপ হয়ে গেলো।’                                                                       (বিষাদের ডাকঘর)    ৫. ‘ডোরাকাটা চিন্তায় চষে বেড়াই নিষিবৃক্ষের অভ্যন্তর।’                                                                       (দগ্ধবৃক্ষের উপবাস)    ৬. ‘এই ইষ্টিশনটা ঘুমের মাদুলিতে ভরে একদিন তোমার বাহুতে বেঁধে দিয়েছিলাম।’                                                                                        (ছায়া অহম)    ৭. ‘সুতি অভ্যাসে কতো পুরাতন শহর এঁকেছি তার হিসেব নেই।’                                                                        (অন্ধকারের সার্সি)    ৮. ‘হৃদয়ের রেহেল খুলে তোমাকেই বারবার পড়ি।’                                                                    (গোপন বিশ্বাস)    ৯. ‘রৌদ্রনদী দাও― কতো দিন হাসির ফোয়ারায় স্নান করি না।’                                                                     (আলোর নকশা)    ১০. ‘দৃষ্টির তাশদিদে মায়ার পেরেক লাগানো আছে, তার পায়ে বিস্ময়ের আলতা পরাই।’                                                                                            (আগুনের যন্ত্রাংশ)― উপমা, রূপক ও প্রতীকের অবয়বটি একান্তভাবেই অভিজ্ঞাতালব্ধ। একেকটি উপমা-প্রতীক মহৎ চেতনার জন্মরহস্য খুলে দেয়, বোধ জাগ্রত করে। কেননা, তা সমাজজীবনে প্রচলিত, বহুমূল্যায়িত এবং জীবনে প্রয়োজনীয়। তার সাথে কাব্যের ভাবদর্শন যোগ হলে ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়। কবিতা মহার্ঘ হয়ে ওঠে। সানাউল্লাহ সাগর এই প্রত্যয়ে স্থিত, জীবনের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। ফলে, তার কবিতা রসসিক্ত, বহুবর্ণিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ।সানাউল্লাহ সাগর আত্মনিষ্ঠ প্রত্যয়ে জীবনমুখী। মগ্ন উচ্চারণে বিভোর তিনি। মানুষ ও মানবতার পাঠ-পূর্ণতা পাবে তার হাতে― এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। জ্বলে উঠুক তার তারাভরা কবিতার খাতা।এসইউ/এবিএস