তথ্যপ্রযুক্তি

‘রোবট দম্পতি’ রাকিব-খুশবু

দু`জনের পুরো নাম রাকিব রেজা ও রিনি ঈশান খুশবু। দু`জনে মিলে গড়ে তুলেছেন ‘প্ল্যানেটার বাংলাদেশ` নামের একটি কোম্পানি। খুশবু তার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আর রাকিব চিফ টেকনোলজি অফিসার। পাস করেছেন বুয়েট থেকে। আর খুশবু চুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী।রোবট তৈরি ও রোবট নির্মাণের উপর প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্যে বছর কয়েক আগে দুজনে মিলে প্ল্যানেটার গড়ে তোলেন। সেই থেকে একসঙ্গে কাজ করছেন। তবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন মাস দুয়েক আগে।প্ল্যানেটার থেকে এ পর্যন্ত যেসব রোবট তৈরি হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ওয়েল্ডিং করতে সমর্থ রোবট, ‘মানবগাড়ি`, ‘টেলিপ্রেজেন্স` ইত্যাদি। ভবন পেইন্ট করতে পারে এমন রোবট তৈরির কাজ এখন চলছে।টেলিপ্রেজেন্স রোবট সম্পর্কে বলতে গিয়ে খুশবু জানান, কয়েকটি দেশে এ ধরনের রোবট ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মাধ্যমে অফিসের বাইরে থেকেও অফিসে কে কী করছেন তা দেখতে পারেন অফিসের প্রধান। এছাড়া চিকিৎসকরা অন্য স্থানে থেকেও রোগীকে পরামর্শ দিতে পারেন, কর্মরত মায়েরা অফিসে বসে ঘরে সন্তানদের দেখে রাখতে পারবেন। টেলিপ্রেজেন্স রোবটকে এমন আরও অনেক কাজে লাগানো যেতে পারে বলে জানান তিনি।এদিকে ‘মানবগাড়ি` রোবট হচ্ছে এমন এক রোবট যেটা নিজেই নিজের আকার পরিবর্তন করতে পারে। যেমন একসময় হয়ত সে মানুষ, তারপর নিজ থেকেই সে গাড়িতে রূপ নিতে পারে। শুধু গাড়ি নয়, অন্য কোনো রূপেও তাকে দেখা যেতে পারে। গোয়েন্দাগিরির কাজে এই রোবট ব্যবহার করা যেতে পারে বলে জানান খুশবু। মানবগাড়ি নামটা খুশবুদের দেয়া। এর টেকনিক্যাল নাম ‘সেলফ রিকনফিগারেবল ট্রান্সফরমার রোবট।` মানবগাড়ি রোবটকে আরও উন্নত করতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা।রোবটের প্রতি খুশবু-র আগ্রহ সেই ছোটবেলা থেকে। সেসময় অনেক বই পড়তেন তিনি। এর মধ্যে মুহম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন পড়তে তার খুবই ভাল লাগে। এছাড়া সায়েন্স ফিকশনধর্মী মুভিও ছিল তার প্রিয়। সেই থেকে রোবটের প্রতি প্রেম, রোবট বানানোর স্বপ্ন দেখা শুরু। স্বপ্ন স্বার্থক করতে ভর্তি হন চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চুয়েট এর যন্ত্রকৌশল বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অংশ নেন বাংলাদেশে তৈরি রোবট নিয়ে আয়োজিত প্রথম প্রতিযোগিতা ‘রোবোরেস`-এ। এরপর যান মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা-র রোবট তৈরি প্রতিযোগিতায়।চুয়েট থেকে পাস করার পর চট্টগ্রামে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজে যোগ দেন। কিন্তু একমাস পরই তার মনে হয় সেটা তার স্থান নয়। ফলে আবার ফিরে যান রোবটের জগতে। রোবট তৈরির পাশাপাশি সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে রোবটের প্রায়োগিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি উৎসাহী শিক্ষার্থীদের দিচ্ছেন রোবট তৈরির প্রশিক্ষণ।বিভিন্ন কাজে রোবটের ব্যবহার নিয়ে সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে কথা বলার পর খুশবু-র মনে হয়েছে, বেশিরভাগ কর্মকর্তা মনে করেন বাংলাদেশে এখনও রোবট ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। ‘‘তারা মনে করেন, কোনো কাজে রোবট ব্যবহার মানে সে কাজের জন্য যে জনবল প্রয়োজন ছিল সেটা আর না লাগা। এতে করে বেকার সমস্যা তৈরি হতে পারে। এছাড়া রোবট ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন -যার অভাব রয়েছে বাংলাদেশে।``তবে এই যুক্তিগুলোর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন খুশবু। কারণ ‘‘রোবট তৈরি ও বাজারজাত করতেওতো জনবল প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। তাছাড়া বিভিন্ন বিপজ্জনক কাজে মানুষের পরিবর্তে রোবট পাঠানোটা বুদ্ধিমানের কাজ,`` বলে মনে করেন তিনি।খুশবু চান বাংলাদেশে এখন যেমন কম্পিউটার আর মোবাইল ফোন বিক্রি ও মেরামতির দোকান গড়ে উঠেছে, রোবটের ক্ষেত্রেও একদিন সেটা সত্যি হবে। এছাড়া একদিন রোবট রপ্তানিরও স্বপ্ন দেখেন তিনি। কয়েকদিন আগে জাপান থেকে পাওয়া একটি ই-মেল তাকে এমনটা ভাবতে উৎসাহী করছে। কারণ শ্রমের মূল্য কম বিবেচনায় জাপানের ঐ ইমেল প্রেরক বাংলাদেশ থেকে রোবট আমদানির সম্ভাবনা জানতে চেয়ে ইমেলটি করেছিলেন।খুশবু-র উপলব্ধি, ‘‘অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিত মানুষরা আমাদের গার্মেন্টস শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে। দেশের রপ্তানি আয়ের একটা বড় অংশ এনে দিচ্ছে তারা। সেখানে আমরা শিক্ষিতরা কী করছি?`` তাই তার স্বপ্ন, একদিন শিক্ষিতরাও ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে এমন একটি খাতের অংশ হয়ে উঠবেন।খুশবু তার স্বপ্নপূরণে পরিবার থেকে সমর্থন পাচ্ছেন। একসময় তিনি যেন নিজস্ব ল্যাব বানাতে পারেন সেজন্য তার বাবা-মা বাসার একটা রুম ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখনও তাদের সমর্থনের কারণেই চাকরি ছেড়ে রোবট নিয়ে পড়ে থাকতে পারছেন খুশবু। তিনি বলেন, ‘‘অবশ্য মা এখন মাঝেমধ্যে চাকরি করার কথা বলেন, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়ার পরামর্শ দেন।``তবে খুশবু এখনও বিদেশে না গিয়ে দেশেই রোবটিক্সে আগ্রহী শিক্ষার্থী গড়ে তুলতে চান। তার মতে- ‘‘আমি এমন পরিবেশ তৈরি করতে চাই যেন আমার ছাত্র-ছাত্রীরা রোবটিক্সে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে কোনোরকম বাধা না পায়।``নিজের স্বামীও এক্ষেত্রে তাকে অনেক সহায়তা করছে। তিনি বলেন, ‘‘রাকিবের সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় এখন আমরা সারাক্ষণই রোবট নিয়ে থাকতে পারছি।প্ল্যানেটার থেকে যত রোবট তৈরি হয়েছে তার বেশিরভাগই রাকিবের হাতে তৈরি বলে জানিয়ে খুশবু বলেন, ‘‘রাকিব খুবই কম কথা বলে। তার মাথা খুবই ঠাণ্ডা। সে অনেক ধৈর্য সহকারে কাজ করতে পারে – রোবট নিয়ে কাজ করার জন্য যেটা প্রয়োজন। রাকিব যদি প্ল্যানেটার এর সিটিও না হতো তাহলে হয়তো এতগুলো রোবট তৈরি হতো না।``রাকিব বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। ২০১১ সালে তিনি ‘রোবোরেস’ প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছিলেন। -ডিডব্লিউআরএস/পিআর