হুমায়ুন আহমেদ নাইম
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এর মধ্যে অন্যতম ঋতু হলো শীতকাল। যেখানে যেমন সুখ আছে বিপরীতে দুঃখও কম নয়। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পৌষ ও মাঘ শীতকাল। তবে অগ্রহায়ণ থেকেই শীতের শুরু হয়। এ সময় রুক্ষতার পাশাপাশি গ্রামের নান্দনিক সৌন্দর্য স্পষ্ট হয়ে থাকে।
শীতকাল শহরের চাকচিক্যময় জীবন থেকে গ্রামীণ জীবনের স্বাদ ভিন্নরকম। গ্রামের শীতের সকাল গুলো শুরু হয় পাখির কিচিরমিচির শুনে। কুয়াশায় ভেজা গাছ, পাতা ইত্যাদিতে শিশির জমে। যখন কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উঠে, সেই শিশিরের সঙ্গে সূর্যের সোনালি রশ্মি মিলে যেন এক অকৃত্রিম দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যের সৃষ্টি করে। এছাড়া খালি পায়ে সেই শিশির ভেজা ঘাসে হাঁটলে অনুভূত হয় স্বর্গীয় সুখ।
শীতের কনকনে ঠান্ডায় পানির মধ্যে কাজ করা এক দূর্বিষহ ব্যাপার। তারপরও খুব ভোরে উঠে পুরুষরা নাস্তা সেরে ক্ষেত-খামারের কাজে চলে যান। কিন্তু শীতের মূল আকর্ষণ থাকে রান্নাঘরে। সকাল হতেই ঘরের মা-বোনদের কাজ হয় পিঠা-পুলি বানানো। চুলার পাশে বসে আগুন পোহাতে পোহাতে পিঠা খাওয়ার স্বাদ অনন্য। শীতের সকালে বেশিরভাগ ঘরে নাস্তা হিসেবে থাকে গরম গরম পিঠা, খুদের ভাত সঙ্গে নানান পদের ভর্তা, খিচুড়ি কিংবা চাপড়ি।
শীতের আসল আমেজ লুকিয়ে থাকে গাছিদের খেজুর গাছ কাটার দৃশ্যে। ভোরে হাড়কাঁপানো শীতে গাছ থেকে নামানো টাটকা খেজুর রসের স্বাদ অতুলনীয়। সেই রস দিয়ে চলে হরেক রকমের পিঠা বানানোর তোড়জোড়। এছাড়া মাটির উনুনে ভাপ দেওয়া গরম গরম ভাপা পিঠা, ধোঁয়া ওঠা চিতই আর সঙ্গে ধনেপাতা বা শুঁটকির ভর্তা কিংবা খেজুরের গুড় আর ঘন দুধে ভেজানো রসালো পিঠার স্বাদ শীতকে যেন আরও উপভোগ্য করে তোলে।
গ্রামের শীতের দুপুরগুলো হয় খুব শান্ত। রোদের মিষ্টি ওম নিতে কেউ উঠানে মাদুর পেতে বসে গল্প করে, মা-চাচিরা কাঁথা সেলাই করেন, কেউ আবার রোদে ডাল বা আচার শুকাতে দেয়। আবার উঠোনেই নরম আলোতে খাওয়া দাওয়াটাও সেরে নেয়।
শীতের দিন ছোট, রাত হয় দীর্ঘ। বিকেলের আলো ফুরিয়ে আসতেই ঝোপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে দূরে টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে থাকা ঘরগুলো এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে। সন্ধ্যার আগে গাছিরা যান খেজুর গাছে রসের হাঁড়ি পাততে।
গ্রামের বিকেলের অন্যতম দৃশ্য হলো ছোট ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলা। সারা হাওরে সারি সারি সরিষা ফুলে ঘেরা মাঠে সবাই মিলে কখনো ক্রিকেট, কখনো ফুটবল কিংবা এসব বিদেশী খেলার বাইরে কখনো দাঁড়িয়াবান্ধা আবার কখনো গোল্লাছুট, বৌছিঁ ইত্যাদি খেলা শৈশবের স্মৃতিকে নাড়িয়ে দেয়।
রাতটা যেমন আনন্দের তেমনি অনেক কষ্টেরও। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডার পরিমাণও বাড়তে থাকে। দারিদ্র্যতার কারণে ভালো গরম কাপড় কেনা অনেকের জন্য কষ্টকর। তাই গ্রামের মানুষরা একসঙ্গে হয়ে খুড়কুটা জ্বালিয়ে আগুন পোহায়, মেতে ওঠে খোশ গল্পে। রাত দীর্ঘ এবং খুব বেশি কাজ না থাকায় দ্রুত খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে যান। আবার সূর্য ওঠার আগেই শুরু হবে নতুন এক কর্মব্যস্ত দিন।
শীতকাল শুধু ঋতু পরিবর্তন নয় বরং এটি আমাদের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শহরের যান্ত্রিকতা ভুলে একটু প্রশান্তির খোঁজে মানুষ বারবার ফিরে যেতে চায় কুয়াশায় ঘেরা সেই মেঠো পথের ধারে। যেখানে পার করে এসেছে রঙিন শৈশব।
আরও পড়ুনবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাসন্ধ্যা নামলেই পুরোনো ইলেকট্রনিক্স পণ্যের হাট বসে যেখানে
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
কেএসকে/এএসএম