বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে দেশকে ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে আমরা সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রোফাইল পিকচার লাল সবুজে পরিবর্তন করেছি। আমিও করতে চেয়েছি। কিন্তু বার বার উদ্যোগ নিয়েও কেনো যেনো নিজেকে সুবিধাবাদী প্রেমিকের মতো মনে হলো। দেশের সবটুকু সৌন্দর্য ও সুবিধাটুকু উপভোগ করে শুধু ভালোবাসি ভালোবাসি বলে আনুষ্ঠানিক ভাবে গলা ফাটানোর মতোই ভণিতা মনে হয়েছে। মনে হয়েছে এই আবেগ এবং শ্রদ্ধা দেখানোর মাধ্যমটি শুধু কি আমরা পোশাকী আবরণে আবৃত্ত করে নিজের মনে নিজে প্রবোধ দিয়ে সান্ত্বনা প্রদান করার মতো নয় কি? নাহ! আমি আমাদের এই আবেগকে মোটেও খাটো করে দেখছি না। শুধু অনুভবের জায়গাটি আবার শানিত করতে চাই, যেনো কোন অপশক্তি আমাদের সেই চেতনার জায়গায় এসে ভর না করে। যেনো নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা এই দিনটিকে হস্তান্তর করতে পারি ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের দিন হিসেবে। যেনো আমাদের সন্তানরা তাদের বংশধরদের চিনে রাখে, যারা পাকিস্তানিদের দালাল হয়ে আমাদের নারীদের শরীরের অংশ খুলে নিয়েছিলো। যেনো তাদেরকেও আমরা শ্রদ্ধা আর সহমর্মিতা দিয়ে চিনিয়ে দিতে পারি যারা এই দিনের জন্য হাসি মুখে চোখের জল নিয়ে জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে। তাদেরকে, যারা স্বাধীনতার জন্য অকুতোভয় হয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন একটি মানচিত্রের জন্য।তাই আমরা যেন শুধু বাৎসরিক পোশাক পরিধানের মতো একটি আনুষ্ঠানিক আচারে এই দিবসটিকে পরিণত না করি। আজ আমাদের সন্তানদের জীবনে বড় বিপদ। নতুন করে আমাদের সন্তানরা আবার নিখোঁজ হতে শুরু করেছে। কয়েকদিন আগে একসাথে দল বেঁধে ঢাকার ছ`জন মেধাবী ছাত্র নিখোঁজ হয়েছে। গত সপ্তাহে বগুড়ার একটি মাদ্রাসা থেকে একসাথে বারোজন ছাত্র-ছাত্রী নিখোঁজ হয়েছে। সবাই জানে গুলশান শোলাকিয়ার ট্রাজেডির আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছিলো। তাই যে কোন সময় আবারো সেরকম কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে তা খুব অস্বাভাবিক নয়। আবারো আমাদের দেখতে হতে পারে নিবরাস রোহানদের মতো এক একজন ধনীর দুলালের দুর্ধর্ষ জঙ্গি হয়ে ওঠা। আবারো দেখতে হতে পারে কি নিষ্ঠুর নির্মমতায় একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে পাকিস্তানি হানাদারদের মতো করেই কোপানো হয়েছিলো! আমরা আমাদের সন্তানদের জানাতে ব্যর্থ হয়েছি মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে ন’মাস লাখ লাখ শহীদের রক্ত ঝরার কথা, বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম, বীর প্রতীকের ত্যাগের কথা। বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেমের কথা,বায়ান্নোর রফিক বরকত সালামের কথা। এরা চেনেনা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, লালন, হাসন রাজা, মধুসূদন, একাত্তরের দিনগুলিতে জাহানারা ইমামের কথা। আমরা চিনিয়ে দিতে পারিনি কারা আমাদের বাবা-চাচা-ভাইকে হানাদারদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো। আমাদের মা-খালা-বোনদের দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছিলো। কারা রাজাকার আলবদরদের হয়ে জাহানারা ইমামের রুমি ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ও নির্যাতন করেছিলো। কারা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়ভাষিণীর জীবনকে নরকের যন্ত্রণায় দগ্ধ করে দুর্বিষহ করেছিলো। আমরা জানাতে পারিনি কারা আমাদের সংখ্যালঘু হত্যা-ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের সাথে জড়িত ছিলো। রণক্ষেত্রে জীবন বাজি রেখে সম্মুখ যুদ্ধে কারা অংশগ্রহণ করেছিলো সে কথা জানাতে। আমরা জানাতে পারিনি কাদের মৃত শরীর শকুনে খুবলে খুবলে খেয়েছিলো। আমরা ভুলে যাচ্ছি হিন্দু নারীর গর্ভে পাকিস্তানি বীজ বপনের কথা। আমাদের বাড়ীর পরিচ্ছন্নতা কর্মী নয়ন তারার মুখে শুনেছি কিভাবে মৃত ভেবে তিন মাসের কন্যা শিশুকে ফুটবল বানিয়ে পাক বাহিনীদের সাথে রাজাকার আল বদরদের পা বদল করে উল্লাসে মেতে উঠে খেলা করেছিলো তাকে নিয়ে। নয়ন তারার মা তার কন্যাশিশুটিকে উঠোনে ফেলে দিয়ে বাড়ির ডোবায় মুখ লুকিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে সে দৃশ্য। কারণ ফেলে না গেলে বাচ্চার কান্নার শব্দে হয়তো ধরা পরে যেত সকলেই। সেই তিন মাসের শিশুই এই নয়ন তারা। আমাদের সন্তানরা আজ এসব ইতিহাস জানে না। আমরাও তাদের জানাতে চাই না। আমরা শুধু এই দিনে ফুলের তোড়ায় বান ভাসিয়ে প্রতিযোগিতা করে ক্যামেরার সামনে দেশ প্রেমিক হতে চাই। আমরা আমাদের সন্তানদের শেখাই না ত্যাগের মহিমার কথা। আমাদের সন্তানরা দেখে আমরা শুধু ঘটা করে একদিন নিজেদের রাঙাই লাল সবুজ মোড়কে। শুধু এ টুকু বলতে চেয়েছি এই মোড়কের পেছনে যেনো না কাঁদে আমার ভাইয়ের ক্ষত বিক্ষত লাশ আর ধর্ষিত বোনের ক্ষত বিক্ষত টুকরো শরীর। অতি সন্তর্পণে এই ইতিহাস গোপন করে ফেলছি আমাদের সন্তানদের নাগাল থেকে। আমাদের প্রজন্ম ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে তাই অন্যের দখলে। কেউ কেউ হয়ে যায় নাফিজ। কেউ কেউ ফাহিম। আবার স্বার্থের তেলে মিথ্যাকে সত্য বলে চিৎকার করতে করতে কেউ কেউ ঢেকে ফেলছে নির্মম সত্যকে। আমাদের কারো কারো সন্তানের জীবনের নিশ্চয়তার কথা ভেবে স্বার্থপরের মতো তাদেরকে নিরুপায় হয়ে সরিয়ে দেই নিরাপদ দেশে। যেখানে তার মাদকাসক্ত সহপাঠীরা তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেবে না। যেখানে আমার আদরের সন্তান হাতে ইয়াবা পেয়ে একজন ঐশী হয়ে উঠবে না। আমাদের নিজেদের মেধা ভালো থাকার আশায় বিক্রি করে দিচ্ছি স্বার্থের কাছে। কিন্তু কিসের অভাব ছিলো আমাদের? কি ছিলো না আমাদের? আমাদের সবকিছু থেকেও আমরা নিজেরা আজ নিজেদের কাছেই ভিক্ষুক। আমাদের সন্তানদেরও আমরা আজ সেই ভিক্ষুকই বানাচ্ছি। এতে আমাদের কোন লজ্জা নেই, ক্ষোভ নেই, নেই কোন বেদনা! আমরা যা করেছি, সন্তানদের কাছেওতো তাই পাবো। নিজের মাকে একা করে ফেলে রেখে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকত্ব নিয়ে আমরা দেশ প্রেমের বড়াই করি। নির্লজ্জ স্বার্থপর আমরা সুখের আশায় দেশ ছেড়ে,মাকে ছেড়ে গিয়ে, দেশপ্রেমের ভান- ভণিতা করি। আমরা খুব সহজেই ভালোবাসি ভালোবাসি বলি। কিন্তু সেই ভালোবাসার দায় আর এখন আমরা নিতে চাই না। দায় নিতে আমরা ভয় পাই। তাই এই দায়বদ্ধতা এড়িয়ে উন্নত দেশের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকত্ব নিয়ে আধাভাঙা উচ্চারণে ইংরেজি বলবো আর বরফের স্তূপের নিচ থেকে মাথা বের করে গান গাইবো ``ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা``! এ বড় হঠকারিতা। বড় বেশি সুবিধাবাদী আচরণ। অনেকদিন পর মনে পড়ে যায় মাইকেল মধুসূদন এর বঙ্গভাষা কবিতা। যারা নিজ স্বার্থে দেশ ত্যাগ করে, তাদের ভিখেরী বলেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আসলেই কি আমরা ভিখেরী নই? হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন; –তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণপরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি; –কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে –“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালেমাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে। যে বিজয়ের লাল আমরা ত্রিশ লক্ষ জীবনের বিনিময়ে পেয়েছি তার প্রতি সম্মান দেখানোর এই আবেগকে আমরা প্রথায় পরিণত করছিনা তো? ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা প্রকাশ করার এই ভঙ্গি শুধু লোক দেখানো আচারে পরিণত করছিনা তো? নিজের স্বার্থের কথা ভেবে, ভালো থাকার কথা ভেবে, নিরাপদ জীবন পাবার লোভে, সন্তানের জীবন মাদকের করাল থাবা থেকে রক্ষা করার নিরুপায় অবস্থার কথা ভেবে বড় বেশি স্বার্থপর হয়ে গেছি আমরা। তাই বছরে একবার সামাজিক প্রথার মতো বিজয় দিবসে লাল সবুজে নিজেকে রাঙ্গিয়ে নিজে একদিনের জন্য দেশপ্রেমিক হয়ে উঠি। তাই ভবিষ্যতে একদিন হয়তো সেটিই বাস্তবতায় পরিণত হয়ে যেতে পারে। কারণ আমরা নিরাপদে বাঁচতে চাই। সন্তানের জীবনের নিশ্চয়তা ও শিক্ষা চাই। তাই সৎসাহস নিয়ে আর বলতে পারি না “মা মাটি দেশ বড় ভালোবাসি তোমায়। তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি। আমরা তোমার কাছে চির ঋণী `` ।লেখক : কলামিস্ট।sharminakhand007@yahoo.comএইচআর/এমএস