নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে বছর জুড়েই আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে ছিল ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা নরসিংদী। কখনো পুলিশের পিটুনিতে প্রাণ গিয়েছে সাধারণ মানুষের। আবার কখনো গ্রামবাসীর হামলায় আহত হয়েছে পুলিশ। দুই গ্রামবাসীর দাঙ্গায় প্রাণ গেছে সাধারণ মানুষের। গ্রাম ছাড়া হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। ৩য় ও ৪র্থ ধাপে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে বছরের শুরুতেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নরসিংদী। জাল ভোট প্রদান, কেন্দ্র দখল ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পেশি শক্তি প্রয়োগের মহড়া ছিল চোখে পড়ার মতো। ইউপি নির্বাচনে প্রতিপক্ষের হামলা-পাল্টা হামলায় প্রাণ গেছে ২ জনের। আহত হয়েছে কমবেশি দুই শতাধিক লোক। নির্বাচনের রেশ কাটতে না কাটতেই পৌর এলাকার ভাগদী মহল্লায় চাঁদা না দেয়ায় প্রাকাশ্যে রড সিমেন্ট ব্যবসায়ী খোকন খন্দকার (৩২) ও আরিফ খন্দকার (৩০) নামে দুই ব্যাবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। প্রবাসী সফিকুল ইসলাম শহরের ভাগদী বালুর মাঠ এলাকায় বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করলে চৌয়ালা এলাকার কয়েকজন সন্ত্রাসী চাঁদা দাবি করেন। এরপর সফিকুল ইসলাম ঘটনাটি আত্মীয়দের জানান। খবর পেয়ে ব্যবসায়ী খোকন ও নিকটতম বন্ধু আরিফ আসলে তাদের সঙ্গে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের কথা কাটাকাটি হয়। এসময় সন্ত্রাসীরা তাদের গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় শহরে আতঙ্ক ও উত্তেজনা বিরাজ করলে ওইদিন রাতেই পুলিশের একটি দল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে ইউএমসি জুট মিল ও নাগরিয়াকান্দি এলাকায় অভিযান চালায়। এসময় পুলিশের গুলিতে নিহত হয় জহিরুল নামে এক ব্যক্তি। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় রাকিব ও হোসেন নামে আরো দুই জন। পরে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় হোসেন নামে আরো একজন মারা যায়। পর পর ৪টি হত্যাকাণ্ডের পর ১৯ মে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের দুই দারোগা (এসআই) আব্দুল গাফফার ও খোকন চন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠে। ৫ লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় গোয়েন্দা পুলিশের দুই দারোগা ভেলানগর এলাকার দীন ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা করে। অভিযুক্ত পুলিশের বিচার দাবিতে নিহতের মরদেহ নিয়ে শহরে ও প্রেসক্লাবের সামনে মিছিল ও মানববন্ধন করে এলাকাবসী। এর কিছুদিন পর বেলাবো বাজারে একটি মোবাইল কোম্পানির নাইটগার্ড মোহাম্মদ আলীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠে গোয়েন্দা পুলিশের এসআই খোকন চন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে। তবে পুলিশের দাবি গ্রেফতারের পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।এদিকে যুবক হত্যার প্রতিবাদে নরসিংদীর বেলাবো বাজারে বিক্ষোভ করে ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী। দোকানপাট বন্ধ করে দেয় স্থানীয় ব্যাবসায়ীরা। পরে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে দোকানপাট খোলা হয়। গঠন করা হয় ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। ২৩ জুলাই নরসিংদীর রায়পুরায় আঁড়িয়াল-খা নদীতে নৌকা ডুবিতে একই গ্রামের ৫ শিশুসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ট্রলারটি যাত্রী বোঝাই করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার গণি শাহের মাজারের ওরসে যোগ দিতে যাওয়ার সময় রায়পুরা উপজেলার উত্তর বাখরনগর ইউনিয়নের জংলী শিবপুর বাজার ঘাটে এ দুঘটনা ঘটে। ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী তোলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রলারের বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা জানিয়েছেন। ১৬ নভেম্বর বছরের শেষের দিকে নরসিংদীতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণশুনানি করেন দুদক। দুদকের গণশুনানিতে কমিশনারের সামনে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসের দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষ। ১১টি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জনসাধারণের সামনে হাজির হলে বিভিন্ন অভিযোগ উপস্থাপিত হয়। এসময় পৌর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। মেয়র বলেন, জেলা প্রশাসন এলআর ফান্ডের কোটি কোটি টাকা কীভাবে কোথায় খরচ করছেন ? এটা নরসিংদীর মানুষ জানতে চায়। একই সঙ্গে ক্যান্ডেল লাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং মাধবদী গরু বাজারের জমি বরাদ্দে শ্রেণি পরিবর্তনে অনিয়মের অভিযোগ তুলেন। তিনি সরকারের প্রদত্ত রোকেয়া পদকের জন্য নরসিংদী থেকে জেলা প্রশাসকের মায়ের নাম প্রস্তাবের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।এরপর ২০ নভেম্বর নরসিংদীতে জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামানের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, প্রশাসক কার্যালয়ের প্রধান ফটক ঘেরাও ও মানববন্ধন করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। প্রায় সপ্তাহজুড়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচি পালন করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। সরকারের দুইটি অংশের এই টানাপোড়েন আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় উঠে বিভিন্ন অঙ্গনে।সূত্র থেকে জানায়, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামানের একটি গোপন প্রতিবেদন ফাঁস হয়ে যায়। প্রতিবেদনে নরসিংদীর পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুসহ একাধিক নেতার বিরুদ্ধে নানা তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। যা প্রশাসনের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের টানাপোড়নের সৃষ্টি করে। এরই ফলশ্রুতিতে সর্বশেষ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে অপসারণের দাবি জানিয়েছে। যা জেলা প্রশাসক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বলে অভিহিত করেছেন। সঞ্জিত সাহা/এমএএস/জেআইএম