ফিচার

পাখি ও প্রাণীর চোখে থার্টি ফার্স্ট নাইট

‎মানুষের ক্যালেন্ডারে থার্টি ফার্স্ট নাইট মানে নতুনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে উল্লাস আলো, শব্দ আর রঙের উৎসব। কিন্তু শহরের আকাশের নিচে, গাছের ডালে, নালার পাশে, ছাদের কোণে কিংবা খোলা মাঠে চলে আরেকটি নীরব ক্যালেন্ডার। যেখানে বসবাস করে পাখি ও নানা ধরনের প্রাণী। সেখানে দিন বদলায় না আতশবাজির আলোয়; বদলায় ভয় আর বিভ্রান্তিতে। সেই ক্যালেন্ডারের পাতায় থার্টি ফার্স্ট নাইট লেখা থাকে অচেনা আতঙ্কের অক্ষরে।‎‎বছরের শেষ রাতকে বরণ করে নিতে মানুষ মেতে ওঠে আতশবাজি, উচ্চস্বরে গান, বাজি ফোটানো, চিৎকার আর পার্টিতে। কিন্তু মানুষ ছাড়া এই পৃথিবীতে আরও অসংখ্য পাখি ও প্রাণী আছে, যাদের জীবন ও অনুভূতির কথা আমরা খুব কমই ভাবি। তাদের চোখে থার্টি ফার্স্ট নাইট কোনো উৎসব নয়; বরং তা এক ভয়ংকর রাত।‎‎পাখিরা শব্দ, আলো ও পরিবেশের সামান্য পরিবর্তনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। থার্টি ফার্স্ট নাইটে যখন হঠাৎ আকাশজুড়ে বিকট শব্দে আতশবাজি ফেটে ওঠে, তখন পাখিদের স্বাভাবিক ঘুম ভেঙে যায়। রাতের অন্ধকারে দিকভ্রান্ত হয়ে তারা হুড়োহুড়ি করে উড়তে থাকে। এ সময় তারা গাছ, বৈদ্যুতিক তার কিংবা দালানের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আহত হয় বা অনেক পাখি মারাও যায়।এছাড়া অনেক পাখি বাসা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফলে ছানারা বাসায় একা পড়ে থাকে। পরে মা পাখি ফিরে আসতে না পারলে ছানা ঠান্ডা ও ক্ষুধায় মারা যায়।‎‎শুধু পাখিই নয়, গৃহপালিত ও বন্য প্রাণীরাও এই রাতে ভয়াবহ মানসিক চাপে পড়ে। কুকুরদের কথা ভাবলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। এই প্রাণীর শ্রবণশক্তি মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। তবে বাজির বিকট শব্দ তাদের কানে বজ্রপাতের মতো আঘাত করে। ফলে অনেক কুকুর ভয়ে কাঁপতে থাকে, লুকিয়ে পড়ে, খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। অনেক সময় অন্যত্রও চলে যায়।

‎‎একইভাবে বিড়ালরাও বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকে। অনেক সময় তারা এতটাই ভয় পায় যে অসুস্থ হয়ে পড়ে। গরু, ছাগল, ঘোড়ার মতো গৃহপালিত প্রাণীরাও আতশবাজির শব্দে অস্থির হয়ে পড়ে। তারা দড়ি ছিঁড়ে পালানোর চেষ্টা করে, নিজেরাই আহত হয়।‎‎অথচ এই প্রাণীগুলো আমাদের নীরব সঙ্গী, তারা আমাদের খাদ্য ও জীবিকার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ‎অন্যদিকে বন্য প্রাণীদের অবস্থা আরও করুণ। শহরের আশপাশের বনাঞ্চলে বা উদ্যানে বসবাসকারী হরিণ, শিয়াল, বানর, সাপসহ নানা প্রাণী আতশবাজির শব্দে ভয় পেয়ে ছুটোছুটি শুরু করে। অনেক সময় তারা রাস্তা পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়, যা তাদের খাদ্য ও নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

এছাড়া আতশবাজির ধোঁয়া পরিবেশকে দূষিত করে, যা প্রাণীদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। ‎পাখি ও প্রাণীদের নিরাপত্তা বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ইন্টার্ন প্রাণী চিকিৎসক মো. রাজিবুল ইসলাম। ‎তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, বিনোদন আমাদের জীবনের একটি অংশ। তবে কিছু অতিরিক্ত বিনোদন আছে, যা পশু ও পাখির জন্য হুমকিস্বরূপ। এর মধ্যে থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ফোটানো অন্যতম, যা পশু-পাখির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।’‎‎আতশবাজির কারণে যেসব ক্ষতি হয়, তা নিচে তুলে ধরা হলো-‎

‎১. চোখের ক্ষতি‎‎আতশবাজির তীব্র আলো পশু ও পাখির চোখে অস্থায়ী কিংবা স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। বিশেষ করে বিড়াল, পাখি ও কবুতরের চোখের রেটিনা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তীব্র আলোর কারণে পাখিরা দিকভ্রান্ত হয়ে উড়ে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়তে পারে।

‎‎২. বিকট শব্দ সবচেয়ে ভয়ংকর‎‎পশু-পাখির শ্রবণক্ষমতা মানুষের তুলনায় অনেক বেশি সংবেদনশীল। হঠাৎ তীব্র শব্দের কারণে তারা প্রচণ্ড ভয় ও মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে। এতে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, অস্বাভাবিক আচরণ দেখা দেয় এবং অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাত পর্যন্ত হতে পারে (গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি)।‎‎৩. ধোঁয়া ও গ্যাসজনিত শ্বাসকষ্ট‎‎আতশবাজিতে সালফার, নাইট্রেট (NO₂) ও বিভিন্ন ভারী ধাতু থাকে। এসব উপাদান শ্বাসযন্ত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলে, ফলে হাঁপানি ও ফুসফুসের সমস্যা দেখা দেয়। ছোট পোষা প্রাণী, বিশেষ করে খাঁচায় থাকা পাখির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।‎‎৪. সরাসরি শারীরিক ক্ষতি‎‎আতশবাজির কারণে পশু-পাখির পা ও পালক পুড়ে যেতে পারে, গুরুতর আঘাত লাগতে পারে। এ ছাড়া পটকার অবশিষ্টাংশ খেয়ে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অনেক সময় মৃত্যুও ঘটে।‎‎মানুষ আনন্দ করতে ভালোবাসে, কিন্তু সেই আনন্দ যেন প্রাণীদের কষ্টের কারণ না হয় এটি আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। নতুন বছর আসুক মানুষের সঙ্গে সব পাখি ও প্রাণীর জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার বার্তা নিয়ে-এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

আরও পড়ুনসন্ধ্যা নামলেই পুরোনো ইলেকট্রনিক্স পণ্যের হাট বসে যেখানেএয়ার অ্যাম্বুলেন্স কী, খরচ কেমন?

কেএসকে