দেশজুড়ে

বগুড়ার বাজারে আলুর স্তূপ, ক্রেতা নেই

বগুড়ায় বেড়েছে আলু চাষের জমির পরিধি। পাইকারি বাজারে নেই ক্রেতাদের আনাগোনা। আলুর দামও তলানিতে এসে ঠেকেছে। দাম না মেলায় অনেক কৃষক খেত থেকে আলু তুলছে না। গত বৃহস্পতিবার খোলাবাজারে পাকড়ি (লাল) আলুর দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১২ টাকায় নেমে আসে। পাইকারি বাজারে সেই আলু আরও কম দামে সাত থেকে আট টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মাঠে কৃষক পাচ্ছে সেই দাম সর্বোচ্চ পাঁচ টাকার মধ্যে।বগুড়ার পাইকারি আলুর বাজার কত দিন এমন মন্দা থাকবে সে বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ এবং কৃষি বিপণন দফতরের কর্তারা স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেননি।কৃষকরা জানান, এই সময়ে মূলত পাকড়ি প্রজাতির আলুর ফলন হয়। গত বৃহস্পতিবার পাইকারি বাজারে সর্বোচ্চ আট টাকা ২০ পয়সা কেজি দরে এই আলু বিক্রি হয়েছে। যদিও এক কেজি পাকড়ি প্রজাতির আলুর উৎপাদন খরচ এই মৌসুমে হয়েছে প্রায় সাত টাকা।বগুড়ায় মোট সবজি আবাদের ৫০ শতাংশ এলাকা এখন আলুর দখলে। বগুড়ার চন্ডীহারার রতন সরকার ও মোকামতলা বাজার এলাকার দেবেন দাস জানান, বাজার পরিস্থিতি দেখে খেত থেকে আলু তোলা বন্ধ রেখেছেন তারা।কৃষি বিশেষজ্ঞ বজলুর রশিদ বলেন, গাছ শুকিয়ে যাওয়ার পর আলু না তুললেও অন্তত ১৫ দিন মাটিতে আলু ভালো থাকবে। ওই কয়েক দিনে বাজার কিছুটা চাঙ্গা হলেও হতে পারে।এক সপ্তাহের অনুসন্ধানে বগুড়া, শিবগঞ্জ, মোকামতলা, শেরপুর, শাজাহানপুর ও কাহালু এলাকা ঘুরে দেখা দেছে চারদিকে শুধু আলু আর আলু। এত আলু তারপরও হতাশ কৃষক। তাদের চেহারায় শঙ্কার ছাপ। ভরা মৌসুমে বাজারে আলুর দাম নেই। খুচরা বাজারে যে আলুর কেজি ১২ টাকা, সেই আলু খেতে বিক্রি হচ্ছে চার থেকে পাঁচ টাকা দরে। বোরো ধান লাগানোর আগে খরচ পোষাতে ‘লস মেকআপ’ ফসল হিসেবে আলু চাষ করেছিল এ অঞ্চলের ৯৯ শতাংশ কৃষক। আশানুরুপ ফলনের পর এখন উৎপাদন খরচ নিয়েই শঙ্কিত তারা। মাঠের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের এই শঙ্কার কথা জানা গেছে।মাটির গুণগত মানের কারণে উত্তরের অন্যান্য জেলার চেয়ে বগুড়ায় আলুর ফলন হয় বেশি। সারা উত্তরাঞ্চল মিলে আলুর যা ফলন হয়, তার প্রায় দ্বিগুণ ফলন হয় বগুড়ায়। এই তথ্য কৃষি বিভাগের। বগুড়ার পাশের জয়পুরহাটেও আলুর ফলন ভালো। এ কারণে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অনেক হিমাগার। বগুড়া থেকে আলু কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান পাইকাররা। অনেকে আলু কিনে পাশেই হিমাগারে সংরক্ষণ করেন পরবর্তী সময় বেশি দামে বিক্রির জন্য। মৌসুমী ব্যবসায়ীরাও আলু কিনে মজুদ করেন এসব হিমাগারে।বগুড়ার মোকামতলা এলাকায় কৃষক আব্দুর রহমান প্রতিবছর জমিতে আলু চাষ করেন। তার মতে, এবার শুরু থেকেই আলুর বাজার পড়ে গেছে। গত বছর আলুর দাম ভালো ছিল। তাই এবার আলুচাষির সংখ্যা ও জমির পরিমাণ বেড়ে যায়। কিন্তু দাম কমে যাওয়ায় তাদের এখন মাথায় হাত। তিনি জানান, এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে প্রায় ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা খরচ হয়। এবার ফসফেট, পটাশ ও কীটনাশক কিনতে হয়েছে বেশি দামে। এরপর আবার কামলার (শ্রমিক) মজুরি ছিল বেশি। সব মিলিয়ে খরচের হিসাব অনুযায়ী প্রতি কেজি আলুর দাম পড়েছে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। সেই আলু এখন বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে খরচার দামেই। এখন ভরা মৌসুম, তাই ইচ্ছা করলেই হিমাগারে আলু রাখারও উপায় নেই।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী এবার উত্তরের ১৬ জেলায় তিন লাখ ১২ হাজার ৮৩ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে শুধু বগুড়ায় ৫৮ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ লাখ ৫৭ হাজার ১৯ মেট্রিক টন। কিন্তু এ পরিমাণের চাইতে প্রায় ৩০ শতাংশ আলু বেশি উৎপাদন হয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ আলু এর আগে কখনো উৎপাদন হয়নি।এ বিভাগের তথ্য মতে, উত্তরের ১৬ জেলায় হিমাগারের সংখ্যা দেড় শতাধিক। এসবের ধারণক্ষমতা ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭০ মেট্রিক টন। বাজারে দাম কম হওয়ায় হিমাগারের ধারণ ক্ষমতার পুরোটাই মজুদ করা হচ্ছে এবার।শিবগঞ্জের আমতলী এলাকার কৃষক আলী আকবর জানান, সাদা হলান্ড আলু এখনকার বাজারে প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকায়। অর্থাৎ পাঁচ টাকা কেজি। অথচ এই আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে এখন তাদের ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা করে লোকসান দিতে হচ্ছে। লাল পাকড়ি আলুর কেজি ১০ টাকা হিসাবে প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকায়। এ আলুতেও কৃষকের প্রতি কেজিতে লোকসান না হলেও লাভ হচ্ছে না। এরপরও হাটে ক্রেতা নেই।বগুড়ার মহাস্থান হাট ঘুরে দেখা গেল সেখানে আলু কিনতে ব্যাপারীদের টানা-হেঁচড়া নেই। হাটে আসা আব্দুল গফুর নামের একজন বলেন, আলু নিয়ে সারা দিন বসে থেকেও ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছি না। এখন হাটেও দাম নেই, মাঠেও দাম নেই।আরএআর/আরআইপি