অবিরাম বর্ষণ ও ভারতের পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। গত দুই দিনের অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে এলাকার বোরো ফসলের খেত তলিয়ে গেছে।
কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার চেল্লাখালী নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে ৫০০ একর জমির বোরো ধান। আরও এক হাজার একরের ফসল ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষকরা।
গত শুক্রবার রাত থেকে শুরু হয়ে রোববার বিকেল পর্যন্ত অবিরাম বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মহারশী ও সোমেশ্বরী নদীর পানির স্রোতের দুই কূল উপচে ঝিনাইগাতী সদর, ধানশাইল, কাংশা, নলকুড়া, গৌরীপুরসহ ১০টি ও নালিতাবাড়ীর রাজনগর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয় বলে জানায় স্থানীয়রা।
এদিকে রোববার সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার পরও থামেনি ভারতীয় পাহাড়ি ঢল। পানি উজানে কমতে শুরু করলেও নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জেলার ঝিনাইগাতি, নালিতাবাড়ী ও নকলা উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে।
স্থানীয় কৃষক, জনপ্রতিনিধি ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঝিনাইগাতি উপজেলার সদর ও বাজারের পানি নেমে গেছে। তবে নিম্নাঞ্চলের বগাডুবি, সুরিহারা, হাঁসলিগাঁও, হাতিবান্ধা, ঘাঘড়া গ্রামের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
ফলে ওসব এলাকার কয়েকশ হেক্টর জমির বোরো খেত একেবারে তলিয়ে গেছে। নালিতাবাড়ি উপজেলার চেল্লাখালী নদীর বাঁধ ভেঙে পাহাড়ি ঢলের পানি নিম্নাঞ্চলে নেমে যাওয়ায় উপজেলার দক্ষিণ সন্নাসীভিটা, নাকশি, বালুঘাটা, তারাকান্দি, সূর্যনগর, যোগানিয়া এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে, উজানের পানি নামতে থাকায় ভাটিতে নকলা উপজেলা উরফা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের কয়েকটি গ্রামের ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এজেডএম শরিফ হোসেন বলেন, পহাড়ি ঢলের পানি উজানের দিকে কমতে শুরু করলেও নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। নিম্নাঞ্চলের চারটি ইউনিয়নের বোরো আবাদ এখনও পানিতে তলিয়ে রয়েছে। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ওসব নিম্নাঞ্চলের লোকজন অনেকটা পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
ঝিনাইগাতী উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম বাদশা বলেন, আমার উপজেলায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। কিন্তু পাহাড়ি ঢল, শিলাবৃষ্টি আর ব্লাস্ট রোগে অর্ধেকের বেশি জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এখনও প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমির ফসল পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে আছে। এবার এলাকার কৃষকদের খুবই খারাপ অবস্থা।
নালিতাবাড়ী উপজেলার বাঘবেড় ইউনিয়নের চেল্লাখালি রাবার ড্যাম সংলগ্ন চেল্লাখানি নদীর তীর রক্ষা বাঁধের পূর্বের ভাঙন অংশ দিয়ে ঢলের পানি প্রবেশ করে শনিবার পাশের তিনটি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, ঢলের পানি রোববার নিম্নাঞ্চলে নেমে যাওয়ায় দক্ষিণ সন্নাসীভিটা, নাকশি, বালুঘাটা, তারাকান্দি, সূর্যনগর, যোগানিয়া এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। চেল্লাখালি বাঁধের সন্ন্যাসীভিটা এলাকায় নতুন করে ২৫ ফুটসহ প্রায় ৭৫ ফুট অংশ ভেঙে গেছে।
উত্তর সন্ন্যাসীভিটা গ্রামের জালাল উদ্দিন বলেন, ‘উপজেলার উত্তর সন্নাসীভিটা গ্রামের কৃষক আবু হানিফ বলেন, ৩০ হাজার টেহা দিয়া দেড় কুর (একর) জমি মেদি (বর্গা) নিছি। আরও ৩০ হাজার টেহা খরচ কইরা ধান করছি। পাঁচ-ছয় দিন পরে ধান কাটার কতা। কিন্তু ভাঙা দিয়া পানি আইয়া খেত ডুইবা গেছে।
ইতোমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মনোয়ারুল ইসলাম, রাবার ড্যাম প্রকল্প পরিচালক ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ, জেলা প্রশাসক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন চেল্লাখালি নদীর ভাঙন অংশ পরিদর্শন করেছেন। বিএডিসির পক্ষ থেকে ভাঙন অংশে বালুর বস্তা ফেলা হলেও পাহাড়ি ঢলের প্রবল পানির স্রোতে ওই বালুর বস্তা ভেসে যায়।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবি) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (জামালপুর) মাজহারুল ইসলাম বলেন, বাঁধ ভাঙার পর আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা বাঁধ মেরামতের জন্য ২ লাখ টাকা বরাদ্দের অনুমোদন দেয়। আমরা বাঁধ মেরামত করতে গেলে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) কর্তৃপক্ষ ও রাবার ড্যাম ব্যবস্থাপনা কমিটি বাঁধ সংস্কার করতে চাওয়ায় পরে আমরা কোনো প্রদক্ষেপ নেইনি।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তরফদার সোহেল রহমান বলেন, ভাঙা অংশে পানি ঠেকাতে বালুর বস্তা ফেলা হলেও প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের প্রবল চাপে সেই বাঁধ ভেঙে যায়। বাঁধটি সংস্কারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ জেলা প্রসাশক মহোদয় পরিদর্শন করেছেন। পানি নেমে গেলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত বাঁধ সংস্কারের ব্যবস্থা করা হবে।
শেরপুর খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচলক মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, জেলায় প্রায় ৪ হাজার ৯০০ হেক্টর জমির বোরো আবাদ অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে ঝিনাইগাতি উপজেলাতে তলিয়েছে সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমির ধান। তবে পানি নেমে গেলে ফসলের খুব একটা ক্ষতি হবে না। কারণ অনেকইে ইতোমধ্যে পানিতে তলিয়ে যাওয়া পাকা ধান কেটে নিচ্ছে বলে দাবি তার।
হাকিম বাবুল/এএম/আরআইপি