কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যগুলো। এক একটি ভাস্কর্য এক একটি সময়ের কথা বলে। ভাস্কর্যে আকার-আকৃতি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মানুষের কর্ম, সময়, চেতনাকে। দীর্ঘকাল ধরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে এসব কথা বলেই যাবে। বার্তা পৌঁছে দেবে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে একাধিক ভাস্কর্য ও স্থাপত্য। প্রতিটি ভাস্কর্য তার গঠন ও বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন রকম। আরা এসব ভাস্কর্য বার্তাও দেয় আলাদা আলাদা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের মধ্যে রয়েছে অমর একুশে, শহীদ মিনার, সংশপ্তক, সেলিম আল-দ্বীন মুক্তমঞ্চ, পদ্ম ফোয়ারা ইত্যাদি।অমর একুশে :জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক (ডেইরি গেট) দিয়ে ঢুকে কিছু পথ এগোলেই চোখে পড়বে অমর একুশে ভাস্কর্যটি। ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটরিয়া সংলগ্ন চত্বরে অবস্থিত ভাস্কর্যটি ১৯৯১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমেদ ভাষা আন্দোলনের স্মারক ভাস্কর্য ‘অমর একুশে’ উদ্বোধন করেন। অমর একুশে ভাস্কর্যটি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির ধারক ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ভাস্কর্য। এর স্থপতি শিল্পী জাহানারা পারভীন। ভাস্কর্যটির স্তম্ভসহ কাঠামোটির মোট উচ্চতা ৩৪ ফুট। এটি নির্মাণ করা হয়েছে চুনাপাথর, সিমেন্ট, ব্ল্যাক আইড, বালি, মডেলিং ক্লে প্রভৃতি দিয়ে।‘অমর একুশে’ মা-বাবার কোলে সন্তানের লাশকে দেখায় এবং এর পেছনে শ্লোগানরত অবস্থায় একজনের প্রতিকৃতি দেয়া হয়েছে। ‘অমর একুশে’ নামের মধ্যে বায়ান্নর সেই উত্তাল সময়কে যেমন ধরে রাখা হয়েছে তেমনি একটি শাণিত চেতনাকেও শরীর দেয়া হয়েছে।শহীদ মিনার বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কলা ভবনের সামনে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু শহীদ মিনারটি অবস্থিত। শহীদ মিনারটির স্থপতি শিল্পী রবিউল হোসাইন। ২০০৪ সালে ৬ নভেম্বর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন ও ২০০৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান। মিনারটিতে ১৯৫২ সালের সকল অর্জনের ভিত্তি বিবেচনা করে এর ভিত্তিমঞ্চের ব্যাস রাখা হয়েছে ৫২ ফুট এবং ৭১ সালের অবিস্মরণীয় মর্যাদার প্রতি সম্মান জানিয়ে ভিত্তিমঞ্চ থেকে উন্মক্ত আকাশগামী স্তম্ভত্রয়ের উচ্চতা রাখা হয়েছে ৭১ ফুট।১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১ কে শ্রদ্ধা নিবেদন করে ভিত্তিমঞ্চে ব্যবহার করা হয়েছে আটটি সিঁড়ি যা ধারাবাহিকতার প্রতীক। ঊর্ধ্বগামী স্তম্ভ তিনটির একটি বাংলাভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, দ্বিতীয়টি মাটি-মানুষ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং তৃতীয়টি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। দৃঢ়তার প্রতীক ত্রিভুজাকৃতির ঋজু কাঠামোর মিনারের স্থাপত্য শৈলীতে বিধৃত হয়েছে সেইসব জাতীয় বীরত্বগাথা যারা মায়ের ভাষা, ভূমির জন্য যূথবদ্ধ হয়ে লড়েছেন, জীবন দিয়েছেন। ক্যাম্পাসের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে শহীদ মিনারের সম্পূর্ণ অংশটিতেই লাল ইটের ব্যবহার করা হয়েছে। ক্লাস শেষে, রোদ্রজ্জ্বল দুপুরে, পড়ন্ত বিকেলে ও রাতভর আড্ডা দেয়ার জন্যও শহীদ মিনারটি ক্যাম্পাসের জনপ্রিয় স্থান।সংশপ্তকবিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার চত্বরে ১৯৯০ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভাস্কর্যটির নির্মাতা হামিদুজ্জামান খান। ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমেদ। শিল্পী ভাস্কর্যটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্রোঞ্জের শরীরে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনাকে এতে দৃশ্যমান করা হয়েছে। ‘সংশপ্তক’ হলো ধ্রুপদী যোদ্ধাদের নাম। মরণপণ যুদ্ধে অপরাজিত রণরাজ। সংশপ্তকের গায়ে প্রতিফলিত হয়েছে ধ্রুপদী যোদ্ধাদের দৃঢ় অঙ্গীকার। আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চেতনাকে দৃশ্যমান করার লক্ষ্যেই ‘সংশপ্তক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূল ভূমি থেকে ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১৫ ফুট। মূল ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জ ধাতুতে তৈরি। এছাড়া এটি নির্মাণে লাল সিরামিক ইট ব্যবহার করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের আড্ডার কেন্দ্রস্থল হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে ‘সংশপ্তক’ চত্বর অত্যন্ত জনপ্রিয়।সেলিম আল-দ্বীন মুক্ত মঞ্চজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের অন্যতম একটি অংশ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে সেলিম আল-দ্বীন মুক্তমঞ্চ। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপনার মধ্যে অন্যতম একটি। বিশ্ববিদ্যায়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠসংলগ্ন ক্যাফেটেরিয়ার পাশে জায়গায় এ মুক্তমঞ্চের অবস্থান। সেলিম আল-দ্বীন, মোস্তফা মনোয়ার ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর পরিকল্পনায় এবং স্থপতি আলমগীর কবিরের নকশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রাণকেন্দ্র এ মুক্তমঞ্চটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালে। ১৯৯২ সালে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমানের সময় এ মঞ্চটি নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং তিনি এর উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের দিনই মুক্তমঞ্চে পরিবেশিত হয়েছিল প্রয়াত নাট্যকার সেলিম-আল দ্বীনের রচনায় কাইজার আহমেদের নির্দেশনায় নাটক `শকুন্তলা`। লাল সিরামিক ইটের তৈরি মঞ্চটি ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে মুক্ত আকাশের নিচে গ্রিক এপিডোরাস থিয়েটারের আদলে নির্মিত। গ্রিক আদলে বাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। লাল ইট দ্বারা নির্মিত এ মঞ্চটির রয়েছে ১৪টি সিঁড়ি এবং এক হাজার ২০০টি আসন। এ মঞ্চকে ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক চর্চার এক ঊর্বর ভূমি বলা হয়ে থাকে। বছরে প্রায় ২৫০টি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে।পদ্ম ফোয়ারা মানুষ প্রকৃতির মাঝে থেকে বাঁচতে চায়। এর জন্য বিধাতা আমাদের চারপাশে প্রকৃতির আচ্ছাদন করে দিয়েছেন। প্রাকৃতিক এ সৌন্দর্যের পাশাপাশি মানুষ কিছু সৌন্দর্য বর্ধন করে থাকে। আর এ রকম একটি বর্ধিত কাজ হলো হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ্ম ফোয়ারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পদ্মফুলের সৌন্দর্যকে তুলে ধরতেই ২০১৩ সালে শিল্পী হাসান আব্দুল্লাহ আল-মাহ্দীর নকশায় পদ্ম ফোয়ারা নির্মাণ করা হয় ক্যাম্পাসে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌরাঙ্গীর পাশে একটি ছোট পুকুরের মাঝে অবস্থিত। রাতে রঙিন আলোর ঝলকানিতে এটির সৌন্দর্য অতিমাত্রায় বর্ধিত হয়।বিএ/পিআর