সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে মহামারি আকার ধারণ করেছে। একেকটি দুর্ঘটনা একেকটি পরিবারের জন্য কতটা ভয়াবহ অভিশাপ তা একমাত্র ভুক্তভোগী পরিবারই জানে। তেমনই ১৭ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় খেলার সাথী বোনকে হারানো এক ভাই অরুণ দাশ (৩২)। মৌলভীবাজার সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা অরুণ তার হারানো বোনের কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। বোন হারানোর কষ্ট এত বছর পরও তার চোখেমুখে স্পষ্ট ভেসে বেড়াচ্ছে।
Advertisement
মৌলভীবাজার পৌর শহরের সাইফুর রহমান রোডের শাহমোস্তফা গার্ডেন সিটির বাসিন্দা অরুণ দাশ সড়ক দুর্ঘটনায় তার বোন হারানোর যে বর্ণনা দিয়েছেন তা হয়ত আমাদের সমাজের সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো প্রতিটি পরিবারের গল্প। যারা নীরবে প্রিয়জনের জন্য চোখের পানি ফেলে যাচ্ছেন বছরের পর বছর।
অরুণ বলেন, ২০০১ সালের ২০ এপ্রিল অন্যদিনগুলোর মতোই ছিল একটি দিন। শুক্রবার সকালে আলুসিদ্ধ, ভাত আর রাতের জন্য তরকারি রেঁধে রেখে দিয়েছিল দিদি, দুপুর বেলার জন্য খিচুড়ি। দিদির মাস্টার্স পরীক্ষা। প্রতি শনিবার পরীক্ষা হতো, দিদি শুক্রবার চলে যেত সিলেট, রাতটা রুমাদির ম্যাচে থাকতো, এমসি কলেজে পরীক্ষা দিয়ে পরের দিন চলে আসতো মৌলভীবাজারে। ২টার সিলেটের বাস ধরতে হবে তাই তাড়াহুড়ো; যথারীতি পাশের বাসার দুজনকে আমাদের খেয়াল রাখার দায়িত্ব দিয়ে দিদির ছুটে চলা। প্রতিদিনের মতো সেদিনও দিদিকে বাসে উঠিয়ে দিতে গিয়েছি আমি। সোমাদি'র (দিদির বান্ধবী) বাসায় রিকশা করে গিয়ে ওনাকে নিয়ে আসতে হলো আমার আর দিদির। দিদিকে যখন বাসে তুলে দিয়ে নামতে যাচ্ছি দিদি আস্তে করে বললো তোমরা ভালো থেকো। কথাটার গুরুত্ব যে এতটা হবে ভাবিনি?
আমি বাস থেকে নেমে ডিভাইডারের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি যতক্ষণ না বাস ছাড়ছে। দিদি বার বার জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখছিল আমাকে। একদিনের জন্য যাওয়া, তবুও আমাদের দুজনেরই খারাপ লাগছিল। বাস যখন চলতে লাগলো দিদি ঘাড় ঘুড়িয়ে আমার দাঁড়িয়ে থাকা দেখছিল আর ইশারা করছিল চলে যাওয়ার। কুসুমবাগ পয়েন্টের বাঁক যখন নিচ্ছিল তখনও দিদি ঘার ঘুড়িয়ে হাত নাড়ছিল, দিদিকে দেখা, শেষ দেখা ছিল তখনই।
Advertisement
দিদি তখন সানমুন ক্যাডেট হাই স্কুলে শিক্ষকতা করতো। বেতন জমিয়ে দিদি নিজের জন্য একটি হার বানাতে দিয়েছিল। পরেরদিন সেই হারটি জুয়েলারি দোকান থেকে আনার কথা ছিল, দিদি পরীক্ষা শেষে প্রায় দিনই সাড়ে ৪টার দিকে চলে আসতো, তো সন্ধ্যার পর সেটি আনার কথা ছিল। ২১শে এপ্রিলও সন্ধ্যা এসেছিল কিন্তু সেটা এত নিষ্ঠুর ভাবে আসবে ভাবতে পারিনি।
তখন আমাদের কারো মোবাইল বা টেলিফোন ছিল না, আমাদের দোতলায় থাকতেন মানিক ভাই। ওনাদের বাসায় টেলিফোন ছিল। পরিচিত সব জায়গায়ই উনাদের নম্বর দেয়া ছিল। বৌদি, বাবুদা, ছোড়দা কেউ বাড়িতে নেই। শুধু আমি আর পিয়া বাসায়। পিয়া তখন ছোট।
বিকেল পৌনে ৩টার দিকে দোতলার কাজের মেয়ে খবর নিয়ে এল আমাদের ফোন আসছে। ফোন ধরার পর ওপাশ থেকে বলা হলো, ‘আমি ওসমানী মেডিকেল থেকে সোমার ভাই বলছি, মমতা তোমার কী হয়?’ বোন বলার পর বললেন ‘একটা প্রবলেম হয়ে গেছে। ও (দিদি) রিকশা থেকে পড়ে পা মচকে ফেলছে এখন একা যেতে ভয় পাচ্ছে তোমার বড় ভাইদের বলো ওকে এসে নিয়ে যেতে।’ এরপর কী পরিমাণ ঝড় যে গেছে আমার উপর দিয়ে; প্রথমে পিটিআই গেলাম পিয়াকে সাথে নিয়ে ছোড়দার কাছে, ছোড়দা আমাকে সিএনজি করে বাড়িতে পাঠালেন এবং তিনি একটা কার রিজার্ভ করে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দিলেন। বাড়িতে খবরটা শোনার পর মা'র কী অস্থিরত? আমরা লাইটেস রিজার্ভ করে সিলেটের উদ্দেশে বের হলাম যাওয়ার সময় মা আমাকে বললেন ‘তাইরে কইছ রেবা রাগ করতো না, আমার প্রেশার বেশি তো সিলেট যাইতে পারতাম না।’ সিলেট ওসমানীতে যখন গেলাম ইমার্জেন্সিতে খোঁজ করলাম মমতা নামের কেউ ভর্তি কিনা? ছেলেটা বললো দুইজন আসছিল এক্সিডেন্টের রোগী একজন তো স্পট ডেড!!!
মাথা ঘুরছিল বড় করে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলাম ভগবান আমার দিদিরে রক্ষা করো। ইমার্জেন্সির ছেলেটা বললো আমি আপনাদের হেল্প করতেছি বলে পাশের রুমে নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি সোমাদি বসে কাঁদছে, ছোড়দাও সেখানে, মেসো (সোমাবৌদির বাবা) সুজিতদা তারাও খবর পেয়ে আমাদের আগে চলে গেছেন। আমাদের দেখে ছোড়দা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। মুহূর্তেই সব শেষ........
Advertisement
দিদি এসেছিল ১২টার দিকে, কয়েক গ্রামের লোক তারও আগে জড়ো হয়েছিল আমাদের বাড়িতে। অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ এতটা বিভৎস এতটা করুণ লাগছিল আর মানুষের চিৎকার, মাকে ছেড়ে আমি তখন উঠানে গড়াচ্ছি, চারদিক থেকে গোঙানোর শব্দ। পাশের বাড়ির একজন দিদি চিৎকার করে বলছেন "মমতা" আইছে। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল, এমন লাগছিল যে ফেটে গেলে বোধহয় শান্তি পাবো।
দিদিকে যখন দেখলাম, ঘুমচোখ দিদির, এক কানে দুল আছে, এক কানে নাই। শান্ত চেহারা, এক হাতের হাড্ডি বের হয়ে গেছে শুধু শরীরে এটুকুই ক্ষত। এই হাতটা বাদ দিলে কেউ বুঝবেও না দিদি এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমি হাত দিয়ে দিয়ে দিদির মুখটা স্পর্শ করছি শেষবারের মতো, জড়িয়ে ধরছি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থলকে।
এরপর থেকে পহেলা বৈশাখ আসে, চৈত্র সংক্রান্তী আসে দিদির হাতের কচি আমের মুগডাল খাওয়া হয় না, দিদির বিয়ে নিয়ে আলাপ হয় না। মা এখনও দিদির ছবি দেখেন না, দিদির সব ছবি আলমারিতে তোলা। জামা কাপড়ও। মুখ ফসকে দিদির প্রসঙ্গ এলে অন্যদিকে কথা ঘুরিয়ে দেয়া হয়, দিদির মৃত্যু এখনও মা মানতে পারেননি।
কয়দিন আগে রাজীবের দুর্ঘটনা নিয়ে যখন সংবাদ হলো, যখন এই শহরের গৌতমদার কিংবা মাহীর এক্সিডেন্টে মৃত্যুর খবর কিংবা নাম না জানা মানুষদের এক্সিডেন্টের খবর শুনি এক ঝটকায় ২১শে এপ্রিল রাতে আমাদের পরিবারের কথা মনে হয়ে যায়। আমার মায়ের আর্তনাদের চিৎকার কানে ভাসে। নিঃশব্দে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি এই পরিবারের মানুষগুলোর বুকের আগুন যেন একটু কম জ্বলে। প্রাণটা বেরিয়ে যাওয়ার মতো যেন কষ্ট না হয় যেমনটা আমার হয়েছিল।
এফএ/পিআর