‘আসসালামু আলাইকুম। আমি পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের একজন কর্মী। আপনার সঙ্গে কি একটু কথা বলতে পারি? আপনার নাম, বাড়ি, বিয়ে করেছেন, সন্তান ক’জন, ওরা ভালো আছে তো, ছোট বাবুটার বয়স কত?’
৭ জুন, সকাল ১১টা। রাজধানীর আজিমপুরে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রবেশদ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক রিকশাচালকের সঙ্গে এমনভাবেই কথা শুরু করেন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের একাধিকবার পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ আলী। কিছুক্ষণের মধ্যেই মোহাম্মদ আলী পথচারীকে নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সাকমো) বেশকিছুক্ষণ তাকে স্থায়ী বন্ধ্যাত্বকরণ পদ্ধতি ভ্যাসেকটমি সম্পর্কে কাউন্সিলিং করেন। অতঃপর রিকশাচালক জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি করাতে রাজি হন।
আরও পড়ুন >> গর্ভবতী মায়েদের ভরসা আজিমপুর মাতৃসদন
স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণে রিকশাচালককে রাজি করানোর পুরস্কারস্বরূপ পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর থেকে মোহাম্মদ আলী নগদ ৩৪৫ টাকা পান। রিকশাচালককে দেয়া হয় নগদ দুই হাজার ৩০০ টাকা।
আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক থেকে শুরু করে পিয়ন-আয়া সবার কাছে অতিপরিচিত নাম মোহাম্মদ আলী। গত ১০ বছর ধরে তিনি স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণে বিবাহিত ও কমপক্ষে দুই সন্তানের জনককে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন। সরকারি চাকরিজীবী ও মাসশেষে বেতনের নিশ্চয়তা না থাকলেও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন মোহাম্মদ আলী। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসারের খরচ চালিয়ে স্ত্রী ও দুই ছেলেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করিয়েছেন।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার সিংহলমুড়ি গ্রামের বাসিন্দা, বর্তমানে লালবাগের শহীদনগরে বসবাসকারী মোহাম্মদ আলী জানান, গত এক দশক ধরে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ সুনামের সঙ্গে পালন করে আসছেন। শুধু আজিমপুর এলাকাতে তিনি একাই ২০ হাজারের মতো পুরুষকে স্থায়ীপদ্ধতি গ্রহণে সহযোগিতা করেছেন।
তিনি আরও জানান, প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে এখানে চলে আসেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে পথচারীদের চেহারা দেখে কথা বলবেন কি বলবেন না, তা ঠিক করেন। প্রতিদিন কমপক্ষে দুইশ মানুষের কাছে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধকরণ কথাবার্তা বলেন। এত মানুষের সঙ্গে কথা বললেও গড়ে দুই থেকে তিনজনকে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করাতে পারেন।
মোহাম্মদ আলী জানান, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় এখন মানুষ দেখলেই তিনি চিনতে পারেন। কার সঙ্গে কথা বললে বকা খেতে হবে, কে নিমরাজি হবেন, আর কে কথাতেই পটে যাবেন- তা বুঝতে পারেন। সম্প্রতি পরিবার পরিকল্পনা সেবা সপ্তাহে শ্রেষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবকের পুরস্কারও পান তিনি।
কোন প্রক্রিয়ায় স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের প্রস্তাব করেন- জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী জানান, বিবাহিত ও কমপক্ষে দুই সন্তান রয়েছে এবং তাদের দুজনই সুস্থ, এমন দরিদ্র মানুষের কাছে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের প্রস্তাব দেন।
ক্লায়েন্টকে তিনি বলেন, সন্তান বেশি হলে সংসারের খরচ বাড়বে। তাই দুটি সন্তানকে ভালো রাখার স্বার্থে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন। এ পদ্ধতি গ্রহণ করলে নগদ দুই হাজার ৩০০ টাকা দেয়া হয়। প্রথম সাক্ষাতেই সরাসরি পদ্ধতি গ্রহণের কথা না বলে বাসায় গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করতে বলেন। স্ত্রী অনুমতি দিলে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের জন্য আসতে বলেন তিনি।
আরও পড়ুন >> প্রসূতির নিরাপদ ঠিকানা ইউএইচএফডব্লিউসি
মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে আলাপকালে পাশেই বসেছিলেন রিকশাচালক (ক্লায়েন্ট) নরসিংদী সদরের বাসিন্দা কলিমুল্লাহ। তিনি জানান, কামরাঙ্গীরচরের মাতবরবাজারে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন। তিনদিন আগে মোহাম্মদ আলী তাকে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের প্রস্তাব দেন। বাসায় ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে ভ্যাসেকটমি করাতে এসেছেন।
‘আমরা গরিব মানুষ। আবার বাচ্চা অইলে খরচ আরও বাড়বো, তাই এ সিদ্ধান্ত। তাছাড়া সামনে ঈদ আসছে। তাই পদ্ধতি গ্রহণ করলে যে দুই হাজার ৩০০ টাকা পামু তা কাজে লাগবে’- বলেন কলিমুল্লাহ।
আজিমপুর মাতৃসদনে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণে অ্যানেসথেসিস্ট (অবেদনবিদ) করেন ডা. লুৎফর রহমান ও ডা. মো. মহসিনুল আলম। তারা জানান, স্বেচ্ছাসেবক ক্লায়েন্ট ধরে আনার সঙ্গে সঙ্গেই তারা ভ্যাসেকটমি করেন না। তারা নিজেরাও ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলে সন্তুষ্ট হলে তবেই অস্ত্রোপচারে যান।
মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান আজিমপুরের তত্ত্বাবধায়ক ডা. ইশরাত জাহান জানান, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পক্ষ থেকে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের হার বৃদ্ধির অংশ হিসাবে এ প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত স্থায়ী ও অস্থায়ী পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ চলছে।
তিনি জানান, গত মে মাসে ২৯০ জনকে ভ্যাসেকটমি, ১২ জনকে লাইগেশন, ৫৭ জনকে ইমপ্ল্যান্ট, ৬৫ জনকে আইইউডি, ৪২ জনকে ইনজেকশন, ১৮৫ জনকে ওরাল পিল এবং ১৯২ জনকে কনডম দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি ভ্যাসেকটমি করানো হলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পক্ষ থেকে ক্লায়েন্টকে দুই হাজার ৩০০ টাকা, চিকিৎসক ৩৪৫ টাকা, স্বেচ্ছাসেবক ৩৪৫ টাকা, সাহায্যকারী ২৪৮ টাকা, আনুষঙ্গিক ৯২ টাকা ও ম্যানেজারিয়াল সাপোর্টের জন্য ১০৯ টাকাসহ মোট তিন হাজার ৪৩৯ টাকা প্রদান করা হয়।
ডা. লুৎফর রহমান ও ডা. মহসিনুল আলম জানান, ভ্যাসেকটমি পুরুষদের জন্য একটি স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যা ছুরি ও কাটাবিহীন, রক্তপাতহীন পাঁচ/সাত মিনিটের একটি ছোট অস্ত্রোপচার। অস্ত্রোপচারের দুদিন পরেই স্বাভাবিক কাজকর্ম করা যায়। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। যৌন ক্ষমতা স্বাভাবিক থাকে। অস্ত্রোপচারের তিন মাস পর এটি কার্যকর হয়। এ তিন মাস নিজে কনডম ব্যবহার অথবা স্ত্রীকে অন্যান্য জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে হয়।
‘পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের ওপর অধিক গুরত্বারোপ করছে। এ পদ্ধতি গ্রহণের হার বৃদ্ধিতে মোহাম্মদ আলীর মতো স্বেচ্ছাসেবকরাই প্রাণ’ বলে মন্তব্য করেন তারা।
এমইউ/এমএআর/জেআইএম