>> কাট্টালি টেক্সটাইলের পরিশোধিত মূলধন ৫৫ কোটি টাকা>> পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করবে ৩৪ কোটি টাকা >> ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে আইপিওতে শেয়ার ছাড়া ‘প্রশ্নবিদ্ধ’>> ভুল পদ্ধতিতে শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) গণনা >> শ্রমিকদের ঠকিয়েছে কাট্টালি টেক্সটাইল!
পুঁজিবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের জন্য হিসাবমান লঙ্ঘন করে প্রসপেক্টাস তৈরি করেছে কাট্টালি টেক্সটাইল। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানটির আইপিও অনুমোদন দিয়েছে।
বিএসইসি’র কাছে জমা দেয়া কাট্টালি টেক্সটাইলের প্রসপেক্টাসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভুল পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) গণনা করেছে। আবার হিসাবমানে না থাকলেও অ্যাডজাস্টেড নামে ইপিএস দেখিয়েছে। অবচয়যোগ্য সম্পদের ওপর অবচয় চার্জ ধার্য করা হয়নি, ফলে বেশি দেখানো হয়েছে মুনাফা ও সম্পদ। লঙ্ঘন করা হয়েছে বাংলাদেশ শ্রম আইনও।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিসাবমান লঙ্ঘন করে প্রসপেক্টাস তৈরি করা কোম্পানিকে আইপিও’র অনুমোদন দেয়া বিএসইসির উচিত হয়নি। পুঁজিবাজার থেকে অর্থ তোলার আগেই যদি কোনো প্রতিষ্ঠান আইন লঙ্ঘন করে তাহলে ওই কোম্পানির সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন >> কাট্টালির আইপিও অনুমোদনের ব্যাখ্যা দিল বিএসইসি
তারা বলছেন, পুঁজিবাজারের বিকাশে নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়া উচিত। তবে সেই কোম্পানির অবশ্যই আর্থিক স্বচ্ছতা ও ফান্ডামেন্টাল অবস্থা থাকতে হবে। দুর্বল ও গোজামিল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোনো কোম্পানিকে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দিলে তা বাজারের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশ হিসাবমান (বিএএস) ৩৩-এর ৬৪ ধারা অনুযায়ী, পূর্বের বছরের শেয়ারপ্রতি মুনাফা নির্ণয় করতে হয় বর্তমান শেয়ার দিয়ে। কিন্তু কাট্টালি টেক্সটাইলের প্রসপেক্টাসে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ইপিএস গণনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শেয়ারকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ফলে প্রকৃত অর্থে ইপিএস যা হওয়ার কথা প্রসপেক্টাসে দেখানো হয়েছে তার থেকে বেশি।
কাট্টালি টেক্সটাইল প্রসপেক্টাসের ১৮৬ পৃষ্টায় ২০১৫-১৬ হিসাব-বছরের মুনাফা দেখানো হয়েছে পাঁচ কোটি ৭৮ লাখ ৬৯ হাজার ১২৬ টাকা এবং ইপিএস দেখানো হয়েছে এক টাকা ৯৯ পয়সা। কিন্তু ওয়েটেড এভারেজ করে ২০১৬-১৭ হিসাব-বছরে শেয়ার দেখানো হয়েছে পাঁচ কোটি ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ৭৬৭টি। সে হিসাবে ২০১৫-১৬ হিসাব-বছরে কোম্পানিটির ইপিএস হওয়ার কথা এক টাকা ১২ পয়সা। অর্থাৎ ভুল পদ্ধতিতে হিসাব করে বছরটিতে ইপিএস ৮৭ পয়সা বেশি দেখানো হয়েছে।
এদিকে হিসাবমানে অ্যাডজাস্টেড ইপিএস বলে কিছু না থাকলেও কোম্পানিটি প্রসপেক্টাসে অ্যাডজাস্টেড নামে ইপিএস দেখিয়েছে। প্রসপেক্টাসে অ্যাডজাস্টেড নামে ২০১৫-১৬ হিসাব-বছরের ইপিএস দেখানো হয়েছে এক টাকা ৫ পয়সা।
কাট্টালি টেক্সটাইলের ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মধ্যে রাস্তা, ওয়াল ও ড্রেনেজ রয়েছে। এগুলোর নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল আছে। তাই বিএএস-১৬ অনুযায়ী, অবচয় চার্জ করতে হয়। কিন্তু কাট্টালি কর্তৃপক্ষ এসবের ওপর অবচয় চার্জ করেনি। ফলে মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখানো হয়েছে।
২০০২ সালে প্রাইভেট কোম্পানি হিসাবে গঠিত কাট্টালি টেক্সটাইলের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০০৪ সালে। এরপর ২০১৬ সালে প্রাইভেট কোম্পানি থেকে পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তর হয়। কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে ৩৪ কোটি টাকা সংগ্রহ করে মেশিনারিজ ও ইক্যুপমেন্ট ক্রয় এবং আইপিও খাতে ব্যবহার করবে। যা ফান্ড পাওয়ার ২১ মাসের মধ্যে ব্যবহার করা হবে।
বর্তমানে কাট্টালি টেক্সটাইলের পরিশোধিত মূলধন ৫৫ কোটি টাকা। পুঁজিবাজার থেকে আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের পর এই পরিশোধিত মূলধন বেড়ে দাঁড়াবে ৮৯ কোটি টাকায়। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের শেয়ারধারণ ৪৯ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়াবে ৩০ শতাংশে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইপিও’র শুরুতেই একটি কোম্পানির উদ্যোক্তাদের শেয়ারধারণ ৩০ শতাংশে নেমে আসা ভালো লক্ষণ নয়। ভালো কোম্পানির উদ্যোক্তারা কখনোই বেশিরভাগ শেয়ার ছেড়ে দেবে না। আবার উদ্যোক্তাদের কাছে কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা কম থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ওই কোম্পানির প্রতি তাদের ভালোবাসা কম থাকবে। এদিকে কাট্টালি টেক্সটাইল পুঁজিবাজার থেকে ৩৪ কোটি টাকা উত্তোলন করলে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের বা আইপিও’র আগে যাদের কাছে শেয়ার আছে তাদের ২২ কোটি টাকা লোকসান হবে। কারণ বর্তমানে কোম্পানিটিতে শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারপ্রতি ২০ টাকা ৪৮ পয়সা হারে ১১২ কোটি ৬৪ লাখ টাকার নিট সম্পদের মালিকানা রয়েছে।
কিন্তু শুধুমাত্র অভিহিত মূল্যে পুঁজিবাজারে আসার অনুমোদন পাওয়ায় কোম্পানিটির আইপিও পরবর্তীতে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য চার টাকা কমে দাঁড়াবে ১৬ টাকা ৪৮ পয়সায়। ফলে আইপিওতে শেয়ার ছাড়ায় বর্তমান শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারপ্রতি চার টাকা হারে মোট ২২ কোটি টাকা লোকসান হবে।
প্রসপেক্টাস অনুযায়ী, কাট্টালি টেক্সটাইল প্রিমিয়াম পাওয়ার যোগ্য হলেও শুধুমাত্র অভিহিত মূল্যে পুঁজিবাজারে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি আর্নিংস বেজড ভ্যালু পার শেয়ার পদ্ধতিতে ২৯ টাকা পাওয়ার যোগ্য বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের ব্যবসায় কোম্পানিটির উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা এই দরের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। অথচ কোম্পানিটি শুধু ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে আইপিওতে শেয়ার ইস্যু করবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারপ্রতি ২৯ টাকা পাওয়ার যোগ্য একটি কোম্পানির শুধু ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে শেয়ার ইস্যুর বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। এক্ষেত্রে কোম্পানিটির কোনো সমস্যা আছে কিনা- তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ সমস্যা না থাকলে শেয়ারপ্রতি ২৯ টাকা পাওয়ার যোগ্য একটি কোম্পানি শুধু অভিহিত মূল্যে আইপিওতে আসতে চাইবে না।
এদিকে বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, নিট আয়ের পাঁচ শতাংশ হারে ফান্ড গঠন করতে হয়। তবে কাট্টালি টেক্সটাইল কর্তৃপক্ষ এ ফান্ড গঠন করেনি। ফান্ড গঠন না করে শ্রমিকদের ঠকানো হয়েছে।
লোকসান হওয়ার পরও ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে আইপিওতে শেয়ার ছাড়ার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কাট্টালি টেক্সটাইলের সিএফও ফজলুল হক জাগো নিউজকে বলেন, প্রচার ও প্রসার এবং আন্তর্জাতিকভাবে ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য আইপিওতে শেয়ার ছাড়া হচ্ছে। এছাড়া আমাদের যে ব্যবসা-বাণিজ্য আছে তার জন্য এগুলোর দারকার নেই।
অবচয়যোগ্য সম্পদের ওপর অবচয় চার্জ না করা এবং শ্রম আইন অনুযায়ী ফান্ড গঠন না করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আইনের সব বিধি-বিধান মেনেই আমরা সব ফান্ড গঠন করেছি। কোথাও কোনো অপূর্ণতা নেই। আর ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মধ্যে থাকা রাস্তা, ওয়াল ও ড্রেনেজের অবচয় চার্জের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ইপিএস গণনায় হিসাবমান লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি এখন বাইরে আছি। প্রসপেক্টাস এখন আমার সামনে নেই। এটা না দেখে বলা যাবে না।
এমএএস/এমএআর/পিআর