মতামত

গ্রামগুলো শহর হলে মানুষ কোথায় যাবে?

গ্রাম ও শহরের মাঝামাঝি আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ঢাকার সঙ্গে তুলনা করলে এটি গ্রাম, আর বিভাগীয় শহরের সঙ্গে তুলনা করলে আধা শহর; কেতাবী ভাষায় মফস্বল। আয়তনে দেশের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম। ফলে নিরেট গ্রাম বলতে যা বুঝায় তা দেখতে আমাকে যেতে হতো ১১০ কিলোমিটার দূরে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিষার গ্রামে, নানাবাড়িতে।

মহিষার দিঘির পাড়ে টঙ্খু মোল্লার ডাইলের পুরি কিংবা অদূরে কাঞ্চনপাড়া হাটে সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে বড় মামার হাত ধরে হাঁটা অথবা ভরদুপুরে এই বাজার সংলগ্ন এক মস্ত শিমুল গাছে ঘুঘুদের গহীন ডাক শুনতে ছুটে যাওয়া—এসবই আশৈশব ও কৈশরের উজ্জ্বলতম স্মৃতি। ফলে এখনও গ্রাম বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে দিগন্তজোড়া হলুদ মাঠ, শীতের ভোরে রসের হাঁড়ি কাঁধে নিয়ে ব্যস্ত মানুষের ছুটে চলা; মাটির সরু রাস্তায় রিকশার এঁকেবেঁকে চলা; রাস্তার ধারে শুকিয়ে আসা খালে লুঙ্গিতে মালকোচা মেরে বয়সী মানুষের মাছ ধরার প্রাণান্ত প্রয়াস; হলুদ খড়ের গাদায় নিজেকে আড়াল কিংবা শীতের সন্ধ্যায় শীত নিবারণের উসিলায় ফসলের শুকনো মাঠে আগুন জ্বালিয়ে বহ্ন্যুৎসব; গ্রামের এইসব অভিজ্ঞতা ও দৃশ্যের সঙ্গে কমবেশি সবারই পরিচয় আছে। কিন্তু সেই গ্রামগুলো নাকি শহর হয়ে যাবে। আসলে কি তা-ই?

গ্রাম আসলে একধরনের বিচ্ছিন্নতা। এখান থেকে এসেছে ‘গ্রাম্যতা’ শব্দটি। মানে যিনি কথিত আধুনিকতার থেকে পিছিয়ে আছেন। যিনি প্রমিত ভাষায় কথা বলেন না, যিনি পোশাকে কেতাদুরস্ত নন, যিনি ওই অর্থে শিক্ষিত সুধীজন বলে পরিচিত নন, তিনি গেঁয়ো, মানে তার ভেতরে গ্রাম্যতা আছে। অথচ এই গ্রামই বাংলার প্রাণ। অথচ এই মানুষগুলোই কৃষিভিত্তিক বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কিন্তু বুঝে কিংবা না বুঝে আমরা গ্রামকে গালি দিই। গ্রাম্যতা বলে উপহাস করি। গ্রাম পিছিয়ে আছে বলে সেটিকে শহর বানিয়ে ফেলতে চাই। আসলে কে চায় বা গ্রামকে শহর বানিয়ে ফেলার এই ধারণাটি কোথা থেকে এবং কীভাবে এলো— সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। এখানে কনসেপচুয়াল মিসটেক বা ধারণাগত ভুল আছে কি না এবং গ্রামগুলো শহর হয়ে যাবে— এই কথার মধ্য দিয়ে একধরনের ভুল বার্তা দেশের মানুষ পাচ্ছে কি না, তাও বোঝা দরকার।

আগেই বলেছি গ্রাম হচ্ছে একধরনের বিচ্ছিন্নতা। অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্নতা। আরও পরিস্কার করে বললে রাজধানীর সঙ্গে যার দূরত্ব বা যোগাযোগ যত বেশি দুর্গম, সে তত বেশি গ্রাম। কেন্দ্রই নির্ধারণ করে দেয় কে পশ্চাৎপদ, কে গ্রাম্য আর কে আধুনিক। গ্রাম সম্পর্কে এই হচ্ছে আমাদের প্রাথমিক ধারণা। অর্থাৎ আমাদের কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থায় সবকিছুই রাজধানীর নিক্তিতে বিবেচ্য। যেন রাজধানীতেই সব আধুনিক মানুষেরা থাকে, যেন রাজধানীই সবকিছুর প্রাণকেন্দ্র, যেন রাজধানীতে যিনি থাকেন না তিনি পশ্চাৎপদ; এই ধারণা থেকেই আমরা সহজেই অন্যকে ‘গেঁয়ো’, ‘গ্রাম্য’ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করি। অথচ সবচেয়ে প্রাচিনপন্থি, সবচেয়ে অনুদার, সবচেয়ে খারাপ, সবচেয়ে মূর্খ এবং সবচেয় অযোগ্য লোকটিও রাজধানীর বিলাসবহুল অট্টালিকার ভেতরে থাকতে পারেন।

আবার রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের বিবেচনায় সবচেয়ে দুর্গম গ্রামেও দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী, সবচেয়ে মানবিক, সবচেয়ে সুন্দর মনের এবং সবচেয়ে আধুনিক চিন্তার মানুষটি সামান্য কাঠ ও টিনের ঘরে বসবাস করতে পারেন। সুতরাং গ্রাম্যতা বলে কাউকে প্রান্তিক করে ফেলার অর্থই হলো তিনি নিজেই পশ্চাৎপদ। এই ধারণার সঙ্গে গ্রামকে শহর বানিয়ে ফেলার আইডিয়া বা ধারণার কোনো তফাৎ নেই।দুই.আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনি ইশতেহারের অন্যতম স্লোগান ছিল ‘আমার গ্রাম আমার শহর’—যেখানে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে প্রতিটি গ্রামকে শহরে উন্নীত করার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। এই বাক্যটি এখানে শেষ হলেই বিপদ। বস্তুত এই বাক্যটিই বারবার উচ্চারিত হয়েছে কিংবা এই বাক্যটি নিয়েই তর্ক হয়েছে। কিন্তু ইশতেহারে এই বাক্যটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, শহরের সুবিধা গ্রামে দেয়া হবে।

আগামী পাঁচ বছরে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। পাকা সড়কের মাধ্যমে প্রতিটি সকল গ্রামকে জেলা/উপজেলা শহরের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। ছেলেমেয়েদের উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করা হবে। সুপেয় পানি এবং উন্নতমানের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। সুস্থ বিনোদন এবং খেলাধুলার জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলো হবে। কর্মসংস্থানের জন্য জেলা/উপজেলায় কল-কারখানা গড়ে তোলা হবে। ইন্টারনেট/তথ্যপ্রযুক্তি সর্বত্র পৌঁছে যাবে।

আতদৃষ্টিতে এই বিষয়গুলোর সঙ্গে গ্রামের মানুষেরও দ্বিমত পোষণের কিংবা নাখোশ হবার কোনো কারণ নেই। কেননা গ্রামের মানুষও চায় সবচেয়ে দূরবর্তী ফসলের মাঠ থেকেও সে তার ফসল তুলে নির্ঝঞ্ঝাটে বাজারে নিয়ে যেতে পারবে, কোনো মধ্যসত্ত্বভোগী থাকবে না, সে নিজেই নিজের ফসল বিক্রি করে পকেটভর্তি টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরবে। গ্রামের মানুষও চায় সন্ধ্যার পরে সে বিদ্যুতের আলোয় টেলিভিশন দেখবে। সংবাদ এমনকি চলমান বিষয় নিয়ে টেলিভিশনের টকশোও এখন গ্রামের হাটবাজারে বসে মানুষ দেখে।

আলোচনায় কে কোন পক্ষে বললেন, কে কতটা নিরপেক্ষ থাকলেন বা পক্ষপাতমূলক আচরণ করলেন, তা নিয়ে আরেক দফা টকশো হয়ে যায় চায়ের দোকানে। ফলে গ্রামের মানুষও চায় শহরের ছেলেমেয়েদের মতো তাদের সন্তানরাও গ্রামে বসেই উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখবে। শহরের স্কুলের মতো ভালো পড়াশোনা হবে। ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে তারাও বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নেয়ার স্বপ্ন দেখবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু বিপত্তি ও আশঙ্কা অন্য জায়গায়। তা হলো মানুষের লোভ, অবিবেচনা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর শুধুই নিজের স্বার্থকেন্দ্রিকতা।

গ্রামকে শহর বানানোর প্রক্রিয়ায় একটি বড় উদ্যোগ হবে শিল্পায়ন তথা কল-কারখানা নির্মাণ। গ্রামে এত জায়গা কোথায়? ফলে কাটা পড়বে ফসলি জমি। যে জমিতে দিগন্তবিস্তৃত হলুদ ও সবুজ দোল খায়, সেই জমিতে কারখানার চিমনি থেকে উড়বে কালো ধোঁয়া। কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার থাকবে না। ফলে সমস্ত বর্জ্য গিয়ে পড়বে অবশিষ্ট ফসলের জমিতে, নদী ও খালে। বুড়িগঙ্গার মতো দূষিত হবে ধানসিঁড়ি, বিশখালী, সন্ধ্যা ও পায়রার স্বচ্ছ জল। তখন বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার সাথে এইসব বহমান স্রোতস্বিনীর কোনো তফাৎ থাকবে না। গ্রামকে শহর বানানোর উদ্দেশ্যে অসততা না থাকলেও যারা এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবেন, যারা দেশে কলকারখানা গড়ে তোলেন, তারা কীভাবে দেশের পরিবেশ ও ফসলি জমি ধ্বংস করেন, উন্নয়নের নামে তারা কীভাবে নদীর গলা টিপে হত্যা করেন, তা দেশের মানুষ বহু বছর ধরেই দেখছে। সুতরাং গ্রামকে শহর বানানো হবে— এই কথা শোনার পরে আমাদের সেই ‘ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখা’র গল্পই মনে পড়ে।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল সার্ক সিড কংগ্রেস ও মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘শিল্পায়ন, বসতবাড়ি নির্মাণ, নদী ভাঙন প্রভৃতি কারণে প্রতি বছর আমাদের প্রায় এক লাখ হেক্টর ফসলি জমি চাষের আওতা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।’ ওই ভাষণেই তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, কৃষির অগ্রগতির সঙ্গে এ অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাছাড়া কৃষি আমাদের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। আমাদের শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক কৃষিতে নিয়োজিত। তার মানে কোনোভাবে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে, মানুষের জীবন-জীবিকা এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে। আর শিল্পায়ন তথা অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে যে কৃষিজমি বেহাত হয়, তার ভুরি ভুরি উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে রয়েছে।

সুতরাং গ্রামকে শহর বানাতে গিয়ে যদি শিল্পায়ন ও উন্নয়নের নামে আমাদের কৃষিজমি বেহাত হতে থাকে, তাতে আপাতদৃষ্টিতে কলকারখানায় কিছু সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আমরা আশাবাদী হলেও দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থান কমবে এবং হুমকিতে পড়বে দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তা। একসময় হয়তো দেশ শিল্পায়নে এগিয়ে যাবে, কিন্তু কৃষিপণ্য আমদানি করতে হবে; যা বিপুল জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত এবং আয়তনে ছোট একটি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।

সুতরাং গ্রামকে শহর বানানো হবে—এই বক্তব্যটি সরকারের তরফে আরও সুনির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। কোনো অবস্থাতেই কৃষি জমি যাতে চাষের আওতা থেকে বেরিয়ে না যায়, আগামীকাল থেকে একটি একর ফসলি জমিও কোনোভাবে বেহাত করা যাবে না এমনকি ব্যক্তিগত ফসলি জমিতেও কোনো ধরনের স্থাপনার নির্মাণের আগে সরকারের অনুমতি নেয়ার বিধান করা জরুরি।

২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ভূমি ব্যবহার কমিটির প্রথম সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, যত্রতত্র শিল্প কারখানা ও বাড়িঘর নির্মাণ বন্ধ করে ভূমির সঠিক ব্যবহার করতে হবে। চাষযোগ্য জমি রক্ষার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ঊর্বর জমি নষ্ট করা যাবে না। চাষযোগ্য জমি রক্ষা করতে হবে। দুই তিন ফসলি জমিতে বাড়ি-ঘর, শিল্পকারখানা নির্মাণ করা যাবে না। শিল্পকারখানা হবে ইপিজেডগুলোতে।

সুতরাং যে নেতা দেশের ফসলি জমি রক্ষায় এত আন্তরিক, এত সংবেদনশীল—তার সরকারের আমলে গ্রামগুলোকে শহর বানানোর কথা মানুষের মনে কিছুটা বিভ্রান্তি ছড়াবে, এটিই স্বাভাবিক। তবে তিনি ও তার দল গ্রামকে শহর বানানো বলতে গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেয়ার কথা বলেছেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু সেই সুবিধা পৌঁছে দেয়ার নামে গ্রামের একটি খালও বন্ধ হবে না, একটি পুকুরও ভরাট হবে না, এক একর ফসলি জমিও ধ্বংস হবে না— সেই নিশ্চয়তাটুকুও জরুরি। কারণ গ্রাম না থাকলে বাংলাদেশ থাকবে না। গ্রামগুলোই বাংলাদেশের প্রাণ, মানুষের অক্সিজেনের কারখানা। শহরের দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে মানুষ যে গ্রামে ছুটে যায়, সেই গ্রামগুলোও শহরে পরিণত হলে তারা কোথায় যাবে?

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/আরআইপি